পোষাক শ্রমিক আন্জু আরা পুলিশের গুলিতে নিহত।
বিলেতের আয়না ডেক্স :- পোষাক শ্রমিক আন্জু আরা পুলিশের গুলিতে নিহত। মায়ের আদর নিতে এসেছিল দুই শিশু, ফিরল তার লাশ নিয়ে স্বল্প বেতনে আলাদা পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মো. জামাল ও আনজু আরা দম্পতি। গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে আনজু আরার মৃত্যু হয়। এই দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছল হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও সন্তানদের কাছে রাখার সামর্থ্য নেই তাদের। আট বছর বয়সী ছেলে মো. আরিফ ও সাত বছর বয়সী মেয়ে জয়া খাতুন গ্রামে তাদের দাদা-দাদির কাছে থেকে পড়াশোনা করে। একটি বিদ্যালয়ে আরিফ তৃতীয় শ্রেণিতে এবং জয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পূজার ছুটিতে ২০ দিন আগে মায়ের আদর নিতে এসেছিল দুই ভাই-বোন। বুধবার (৮ অক্টোবর) মা আনজু আরার লাশের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামে ফিরতে হলো ছোট্ট দুই সন্তানকে। নিহত আনজু আরার স্বামী মো. জামাল বলেছেন, তার স্ত্রী শ্রমিক বিক্ষোভে ছিলেন না। বিক্ষোভের কারণে সকাল আটটার দিকে কারখানা ছুটি হওয়ার পর জরুন এলাকার বাসায় সন্তানদের কাছে ফিরছিলেন আনজু আরা। পথে কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে। সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনজু আরার লাশের সুরতহাল করা হয়। পরে তার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যার পর স্বজনেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে রওনা দেন। আনজু আরার দুই শিশুসন্তানও মায়ের লাশের সঙ্গে ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ির পথে রওনা হয়। আনজু আরার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, আনজু আরার মাথায় গুলির আঘাতের কোনো চিহ্ন তিনি পাননি। তার শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে মনে হয়েছে, হুড়োহুড়ির সময় আনজু আরা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন মানুষের পায়ের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। আনজু আরাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনার পর রেজিস্টারে ‘গুলির আঘাতজনিত’ সমস্যায় আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আলাউদ্দিন বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই আনজু আরা মারা যান। তাকে জরুরি বিভাগে আনার পর স্বজনেরা বলেছেন, গুলিতে আহত হয়েছেন। সেটিই প্রাথমিকভাবে রেজিস্টারে লেখা হয়েছে। তার মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক খতিয়ে দেখবেন। সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় আনজু আরার স্বামী জামালের সঙ্গে। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি তখন স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। জামাল বলেন, আনজু আরা ইসলাম গার্মেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। আর তিনি নিজে কাজ করেন ডিজাইন প্রিন্টিং নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিনের মতোই গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টায় তারা বাসা থেকে কারখানার উদ্দেশে রওনা দেন। আনজু আরাকে কারখানায় তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জামাল বলেন, পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তিনি কারখানা থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নিতে যান। কারখানার সামনেই আনজু আরার সঙ্গে তার দেখা হয়। সকাল আটটার দিকে মাইকে আনজু আরার কারখানা ছুটির ঘোষণা আসে। তখন স্ত্রীকে বাসায় যেতে বলেন জামাল। বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। একটি গুলি এসে আনজু আরার মাথায় লাগে। প্রথমে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আশরাফ উদ্দিন রাতে বলেন, বিক্ষোভের সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পড়ে গিয়ে আহত হন আনজু আরা। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, তা জানতে পারেননি। স্বজনেরা জানান, জামাল ও আনজু আরার বিয়ে হয় ২০১৪ সালে। তারা দুজনই তখন তেজগাঁও এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। দুই বছর আগে তারা গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার দুটি কারখানায় কাজ নেন। জামাল জানান, দুজন মিলে প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকায় সন্তানদের নিয়ে চলা সম্ভব নয়। সে কারণে ছেলে-মেয়েদের দাদাবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বিদ্যালয় ছুটি হলে অল্প দিনের জন্য দুই সন্তানকে নিজেদের কাছে এনে আদর করতেন।