জুন ১০, ২০২৩

জাতীয়

মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সিরাজুল আলম খান।

বিলেতের আয়না ডেক্স :- মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সিরাজুল আলম খান। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলীপুরে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক,স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ‘ সিরাজুল আলম খান। শনিবার (১০ ‍জুন) ৬টার দিকে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যদায় মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। জানা যায়, দুপুর দুইটার দিকে আলীপুর গ্রামের পৈতৃক ভিটায় সিরাজুল আলম খানের মরদেহ আনা হয়। সেখানে এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় প্রিয় নেতার লাশ দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।  পরে বাদ আছর বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তার তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খানকে বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মকতা মো. ইয়াসিন আরাফাতের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দাদাভাই হিসেবেও পরিচিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তার উদ্যোগে। শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।

সাম্প্রতিক

বাঙালির মহান জাতীয় বীর সিরাজুল আলম খানের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি

বিলেতের আয়না ডেক্স :- জিয়াউল হক মুক্তা বাঙালির মহান জাতীয় বীর সিরাজুল আলম খানের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালির বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জনাব খোরশেদ আলম ও মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সিরাজুল আলম খান ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁকে বদলি হতে হয়েছে। সেই সুবাদে সিরাজুল আলম খান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালের নভেম্বরে তিনি আব্দুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা) ও কাজী আরেফ আহমেদকে (পরবর্তীতে জাসদ নেতা) সাথে নিয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রধানত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠন করেন গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ বা নিউক্লিয়াস। পরবর্তীতে এই গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আরো যোগ দেন আবুল কালাম আযাদ (পরবর্তীকালে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা) ও আব্দুল মান্নান (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা)। দারিদ্র্যের কারণে পরে আবুল কালাম আযাদ শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হবার জন্য ও সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য আব্দুল মান্নানকে এই প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়; এঁদের স্থলাভিষিক্ত হন মনিরুল ইসলাম বা মার্শাল মনি (পরবর্তীকালে জাসদ নেতা)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালের জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শেখ ফজলুল হক মনি। দায়িত্ব গ্রহণের কিছুকালের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ব্যক্তিগত কারণে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল আলম খান। মূলত এই সময়েই তিনি সারা পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতাকামী ছাত্রতরুণদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। ১৯৬৩ সালের ৭ নভেম্বরের সম্মেলনে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের মার্চের পর তিনি আরো কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে কারান্তরীণ হন। ১৯৬৫ সালের জুলাই/আগস্ট মাসে কারামুক্তির পরে সেপ্টেম্বরের ৫-৬ তারিখে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ সম্মেলনে তিনি আব্দুর রাজ্জাকের কাছে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন; এসময় তিনি আবুল কালাম আযাদকে দায়িত্ব দেন ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র রচনা করতে। আবুল কালাম আযাদ দু’জন স্কুল শিক্ষার্থীর সহায়তা নিয়ে তা রচনা করেন ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় পাঠ করেন। বর্ধিত সভার পরে ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসমেত ছাত্রলীগ ওই গবেষণাপত্রটি জনবোধ্য পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করে এবং সারা পূর্ব বাংলায় ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ নিয়ে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে। ছাত্রলীগ কর্তৃক ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ক প্রচার অভিযানের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে ডান-মধ্য-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ইসলামপন্থিরা একে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলেন, মস্কোপন্থি কমিউনিস্টগণ একে সিআইএ-র বানানো দলিল ও শেখ মুজিবকে সিআইএ-র দালাল বলেন, চিনপন্থি কমিউনিস্টগণ একে র-এর তৈরি দলিল ও শেখ মুজিবকে ভারতে দালাল বলতে থাকেন। এমনকি আওয়ামী লীগও দল হিসেবে ভেঙে যায়— ছয় দফাপন্থি আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এর আট দফাপন্থি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সকল সিনিয়র নেতৃত্ব শেখ মুজিব ও ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৬৬ সালেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস বিদ্যুৎগতিতে ছয় দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং ছয় দফাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধানতম অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সিরাজুল আলম খানের সহযোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদ সর্বপ্রথম ছয় দফা সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেন। ছয় দফা ঘোষণার অপরাধে পাকিস্তানী শাসকরা শেখ মুজিবকে দ্রুত কারান্তরীণ করলে সিরাজুল আলম খান তাঁর মুক্তির দাবিতে ও ছয় দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ধর্মঘট সংঘটিত করেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতা কর্তৃক এই ধর্মঘট আহুত হলেও সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীগণ শ্রমিকদের সাথে নিয়ে এই ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করেন। ছয় দফা আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিতে সিরাজুল আলম খান শ্রমিক আন্দোলনের ট্রেড ইউনিয়নবাদি ধারা থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের শ্রমিক ফ্রন্ট হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন করেন এবং মস্কোপন্থি ও চিনপন্থি কমিউনিস্টদের কবল থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে উদ্ধার করে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেন। প্রকাশ্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি ১৯৬৮ সালে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা বিএলএফ। বিএলএফ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জঙ্গিরূপ রূপ দিতে গণআন্দোলনে সীমিত পরিসরে বল প্রয়োগের কাজ শুরু করে। কারান্তরীত শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বিচার কার্য শুরু করলে সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে মস্কোপন্থি ও চিনপন্থিদের সাথে ১১ দফা ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলেন; মস্কোপন্থিরা ছয় দফায় ঘোষিত পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা মুদ্রার ব্যাপারে একমত না হলে, এই একটি বিষয় বাদ দিয়ে ছয় দফার বাকি সব দফা যুক্ত করে ১১ দফা গ্রহণ করেন। সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের তখন একটাই শপথ, যে কোনো মূল্যে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করতে হবে। ১১ দফার ভিত্তিতে দুর্বার ছাত্র আন্দোলনকে নিউক্লিয়াস ‘ছয় দফা না হলে এক দফা’র (অর্থাৎ স্বাধীনতা)আন্দোলনে পরিণত করেন। এক দফা বা স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার এই পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীগণ গভীর জাতীয়তাবাদি জনপ্রিয় শ্লোগানগুলোর জন্ম দেন; এই সময়ই তাঁরা মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাঙালির জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান প্রবর্তন করেন। বিদ্যুৎগতিতে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ প্রবর্তনের পর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত শেখ মুজিবকে অতি দ্রুত ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এককভাবে সম্বর্ধনা প্রদান করে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৬৯-১৯৭০ সালের ছাত্রলীগ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করলেও এর আগেই ১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দেয়ালিকা পত্রিকা ‘প্রতিধ্বনি’তে ছয় দফার পক্ষের একটি রচনায় নিউক্লিয়াসপন্থি ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরি মুশতাক সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের জন্য বঙ্গবন্ধু অভিধাটি ব্যবহার করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রস্তুতিকালে সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার পক্ষের তরুণ নেতৃত্বকে নির্বাচনের প্রার্থী করতে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেন। ১৯৭০ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরুত্তাপ মনে হলেও নিউক্লিয়াস এই সময়টিকে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার দাবি এগিয়ে নিতে বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ‘সার্জেন্ট জহুর বাহিনী’ বা ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করেন ও কুচকাওয়াজ করে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ধর্মঘটটি শ্রমিকদের শহিদ হবার দিন হওয়ায় এদিনে পল্টন ময়দানে শ্রমিক সমাবেশ আয়োজন করা হয়;

Scroll to Top