বিলেতের আয়না ডেক্স :- যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, সংঘাত, যৌন সহিংসতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৭০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে বৈশ্বিক অংশীদারদের সাথে সমন্বয় করে শনিবার (১০ ডিসেম্বর) এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিশ্বের প্রভাবশালী ওই দুই দেশ। এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, বিশ্বের নয়টি দেশের ৪০ জনেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। এ ৯টি দেশ হলো— উত্তর কোরিয়া, এল সালভাদর, গুয়েতেমালা, গিনি, ইরান, মালি, ফিলিপাইন, রাশিয়া ও চীন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে দুর্নীতিবাজ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ২০২২ সাল জুড়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ। এর অংশ হিসেবে আলবেনিয়া, বসনিয়া, মন্তেনেগ্রো, কসোভো, উত্তর মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, বেলারুশ, লাইবেরিয়া, গুয়েতেমালা, রাশিয়া, মিয়ানমার এবং ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বছরব্যাপী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখন বছরের শেষ দিকে এসে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় জায়গা পেল আরও ৪০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় উত্তর কোরিয়া সংশ্লিষ্ট ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ফুনসাগা পিটিই লিমিটেডের পরিচালক দীপক যাদবের নাম রয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নতুন করে মার্কিন ও ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে অনেকে গুজব ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেখানে বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অব দ্য ট্রেজারি ফর টেরোরিজম অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্সের কর্মকর্তা ব্রায়ান ই নেলসন বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার ফাঁক ফোকরের ওপর নির্ভর করে অপরাধ সংঘটিত করে। গত কয়েক বছরে ট্রেজারি বিভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।’ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ও অন্যান্য দেশে থাকা এসব অপরাধীদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ করে তাদের থামানোর চেষ্টা করা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, একই দিনে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ৩০ রাজনীতিক, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এবং বিশ্বজুড়ে সংঘাত-সংশ্লিষ্ট যৌন সহিংসতার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য। শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি এক বিবৃতিতে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্রিটেনের এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় বন্দী নির্যাতন এবং বেসামরিক নাগরিকদের ধর্ষণের জন্য সৈন্যদের প্ররোচনাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংস কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার জঘন্যভাবে লঙ্ঘনের পেছনে যারা রয়েছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচনের পথ সুগম করছে আমাদের নিষেধাজ্ঞা। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সামরিক এবং নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধানের কার্যালয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটির সরকার বলছে, মিয়ানমারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর থেকে দেশজুড়ে গণতন্ত্রকামীদের দমন-পীড়ন এবং যৌন সহিংসতার মতো নানা ধরনের অপরাধের সাথে সামরিক ও নিরাপত্তা প্রধানের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ৩৩তম ও ৯৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনকে এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে ২০১৭ সালের আগস্টে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চলাকালীন এই দুই ডিভিশনের সদস্যরা দেশটির সংখ্যালঘু জাতিগত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে। ওই সময় রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩৩তম ও ৯৯তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। দেশটির গণতন্ত্রকামী হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে সহিংসতা চালানোর অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্যের এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছেন ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ৯০তম ট্যাংক ডিভিশনের প্রধান কর্নেল রামিল রখমাতুলোভিচ ইবাতুলিন। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর থেকে তিনি ৯০তম ট্যাংক ডিভিশনের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্রিটেনের সরকার বলেছে, ৯০তম ট্যাংক ডিভিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইউক্রেন সংঘাতের সময় যৌন নির্যাতন, হত্যা, লুটপাটের মতো একাধিক অভিযোগ রয়েছে। যৌন সহিংসতার দায়ে ইতোমধ্যে ইউক্রেনে আটক রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর এই ইউনিটের একজন সিনিয়র লেফটেন্যান্টকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ইরানের কারাগার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ব্রিটেন। তাদের মধ্যে ইরানের বিপ্লবী আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট ৬ কর্মকর্তা রয়েছেন। যারা বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের সাজা দিচ্ছেন। হিজাব পরার বিধান লঙ্ঘনের দায় ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সী তরুণী মাহসা আমিনি মারা যান। পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে দেশটিতে হিজাব-বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন হাজার হাজার মানুষ। এই বিক্ষোভ এখন সরকার-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের মাঝের দিকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ইরানের বিচারবিভাগ এখন পর্যন্ত ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছে। নারীদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিক্ষোভ ইরানের ৩১টি প্রদেশের ১৬০ শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের এবারই প্রথম ইরানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। অতীতে রাশিয়া, মিয়ানমার এবং ইরান নাগরিকদের ওপর নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাজ্যের এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় পাকিস্তান, নিকারাগুয়া, মালি, কসোভো, সার্বিয়া, দক্ষিণ সুদান, উগান্ডার নাগরিকরাও রয়েছেন। পৃথকভাবে বৈশ্বিক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বার্ষিক পর্যালোচনায় ব্রিটেনের সরকার বলেছে, গত বছর চীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। ওই সময় দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ভয়াবহ নিপীড়ন’ চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি। তালিকায় নেই বাংলাদেশ প্রতিবছর মানবাধিকার দিবসের (১০ ডিসেম্বর) প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সামরিক ও অন্যান্য বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা ও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকার। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মাদকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধে অংশ নিয়ে র্যাব আইনের শাসন ও মানবাধিকার খর্ব করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ এতে হুমকির মুখে পড়ে।