বিলেতের আয়না রিপোর্ট:- ইফতেখার মহম্মদ তুহিন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ম. আ. মুক্তাদির এর সংগ্রামী জীবন
“Man is Mortal” মানুষ মরণশীল। আমাদের প্রত্যেকেরই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, এটাই চিরন্তন সত্য। ইতিহাসে অমর হওয়ার মত মৃত্যুর সংখ্যা কত, প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হলেও আমরা কত জনকে স্মরণ রাখছি, তবুও অনেক মৃত্যু আমাদেরকে ভাবায়, এমনি এক মহান ব্যক্তিত্ব আমাদের সবার কাছে প্রিয় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক মরহুম ম. আ. মুক্তাদির। আজ ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি জাতীর শ্রেস্ট সন্তান, বিপ্লবী এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে !
তিনি ১৯৫২ সালে দক্ষিণ সুরমার কদমতলী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম মুসলিম মিয়া, পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ভাইবোনদের মধ্যে পঞ্চম ও ভাইদের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি রাজা জি সি হাই স্কুলে ভর্তি হন। একজন ভাল ক্রিয়াবিদ ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের প্রাথমিক সদস্য পদ লাভ করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৭/৬৮ সালে দেশ ও কৃষ্টি আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি কৃতিত্তের সহিত এস এস সি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভুখানে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সংগঠক। মদন মোহন কলেজ থেকে তিনি ১৯৭০ সালে আই এ পাশ করেন। তিনি সিলেটের ফুটবল জগতে হোয়াইট মোহামেডানের একজন সক্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন এবং দক্ষিণ সুরমা ক্রীড়াচক্রেরও খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি কিছুদিন সংবাদিকতায় নিযুক্ত ছিলেন। তার প্রতিভা সমাজের বিভিন্ন জায়গায় পরিলক্ষিত হয়।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মা-বোনদের ইজ্জত, দেশমাতৃকাকে মুক্ত ও একটি স্বাধীন লাল সবুজের পতাকার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধে জাপিয়ে পড়েছিলেন জাতীর শ্রেস্ট সন্তানরা তাদেরই একজন জাতীর শ্রেস্ট সন্তান সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ২৬ নং ওয়ার্ড এর কদমতলী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ম. আ. মুক্তাদির। তিনি মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে ৪নং সেক্টরে একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলিস্ট ভুমিকা রাখেন।
মরহুম ম. আ. মুক্তাদির একটি স্বাধীন পতাকা, একটি স্বাধীন মানচিত্র, একটি স্বাধীন নিঃশ্বাসের জন্য মুক্তিযোদ্ধকে বেছে নিয়েছিলেন আর রাজনীতিকে বেছে নিয়েছিলেন যাতে সমাজে মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো প্রতিস্টিত হয়, সমাজের অমূল্য পরিবর্তন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষের বিপ্লব ঘটানোর লক্ষে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছিলেন। নির্যাতন আর জেল-জুলুমকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন নতুন সূর্যোদয়ের আশায়। তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষে একজন নিবেদিত সমাজকর্মী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি আমৃত্যু স্বপ্ন দেখে এসেছেন একটি অসাপ্রদায়িক, গনতান্ত্রিক,সমাজতান্ত্রিক, শোষণহীন বাংলাদেশের।
৭০ ও ৮০ দশকের আপোষহীন ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ এর জন্মলগ্নে ছাত্রলীগে যোগ দেন এবং জাসদ সংগঠনের বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে ১৯৭৩ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এম.সি কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষা দেন। ১৯৭৬ সালের ৯ জুন জাসদ রাজনীতির চরম দুর্দিনে জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মনোনীত হন তিনি। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বার ছাত্রলীগ সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে বাসদ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা বাসদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব গ্রহণে তিনি কিছুদিন বাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এক কথায় সিলেটে বাসদের জন্মদাতা মরহুম ম. আ. মুক্তাদির। বাসদ এবং ছাত্রলীগ যতদিন থাকবে মুক্তাদিরও ততোদিন প্রতিস্টাতা হিসেবে বেঁচে থাকবেন। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে বাসদ সমথন দান করে। সিলেট অঞ্চলে ওসমানী সাহেব বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার পেছনে মরহুম ম. আ. মুক্তাদিরের অবদান চিরস্মরণীয়। ১৯৮৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
স্বৈরশাসক এরশাদ এর শাসনামলে নির্যাতন, জেল, জুলুম আর গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তিনি ১৯৮৬ সালে লন্ডনে পাড়ি জমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখেন ,তেমনি লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে বাসদকে সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীকালে লন্ডনের লেবার পার্টিতে যোগ দেন। বিলেতের মাটিতে তিনি শুধু রাজনীতিতেই সীমাবব্দ ছিলেন না। সামাজিক ও সংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার যথেষ্ট বিস্তার ছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারী, শহীদ দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় অনুস্টান গুলোতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি লন্ডনে প্রবাসী সিলেটী ও বাঙালিদের দাবী-দাওয়া বাস্তবায়নের আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, প্রবাসী বাঙালিদের হয়রানি, নারী নির্যাতনসহ মানবতা বিরোধী বর্ণবাদ বিরোধী প্রতি আন্দোলনে তার ছিল একটা বলিস্ট কণ্ঠস্বর। তিনি সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ঘোষিত আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করেন এবং স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে লন্ডনে বলিষ্ঠ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেখানোর মধ্যদিয়ে নিজের দেশ ও জাতির প্রতিই সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ম. আ. মুক্তাদিরের প্রতি সম্মান দেখাতে আজ আমরা ও ব্যর্থ। তার জীবনাবসানের দীর্ঘ ২৪ বছর অতিবাহিত, আজও তার নামে দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ব। মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৮-৯৯ ইং সালে তৎকালীন নৌ-ও পরিবহন মন্ত্রী আ স ম আব্দুর রবের নির্দেশে কদমতলী এলাকার ফেরিঘাট সড়ক থেকে জকিগঞ্জ সড়ক পর্যন্ত যে রাস্তাটি বিদ্যমান, সেই রাস্তাটি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের নামে সরকারীভাবে নামকরণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর আওতায় রাস্তা পাকা করনের কাজের টেন্ডার ইস্যু করা হয় এবং কাজটি সম্পূর্ণ হয়, তখন থেকে এ সড়কটি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের নামে সরকারী কাগজপত্রে বলবৎ থাকলে ও বাস্তবে রাস্তার কোথাও মুক্তাদিরের নামের অস্থিত্ব নেই। এ নিয়ে এলাকায় রয়েছে মতবেদ, যার ফলে আড়ালেই রয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মুক্তাদিরের নাম। “বর্তমানে দেশে বিদেশে থাকা সচেতন মহল এবং ম. আ. মুক্তাদির স্মৃতি কল্যাণ ট্রাস্ট এর সকল সদস্যবৃন্দের একটাই দাবী মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ম. আ. মুক্তাদিরের নামে কদমতলী এলাকার ফেরিঘাট সড়ক থেকে জকিগঞ্জ সড়ক পর্যন্ত যে পাকা রাস্তাটি [ মরহুম ম. আ. মুক্তাদিরের বাড়ির পশ্চিমের রাস্তাটি], সেই রাস্তাটি মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মুক্তাদিরের নামে সরকারীভাবে নামকরণ করা হোক, যাতে করে আগামী প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখতে পারে এই বীর, সাহসী, বিপ্লবী সন্তানকে।“
মরহুম ম. আ. মুক্তাদির ১৯৯৭ ইং সালের ১২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার লন্ডনে ‘বাংলা টাউন’ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার সমূহ জড়িত থেকে অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার সময় অসুস্থবোধ করেন। তাঁকে সাথে সাথে লন্ডন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় লন্ডন সময় ১৪ সেপ্টেম্বর রাত ১০ টায় হাসপাতালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহ বিশেষ বিমান যুগে লন্ডন থেকে দেশে আনা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। পরে দক্ষিণ সুরমার কদমতলী গ্রামের সেই স্মৃতিঘেরা মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এই ক্লান্ত বিপ্লবী সৈনিককে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ পুত্র সন্তান, (বড় ছেলে রাহাত মুক্তাদির লন্ডনে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নিহত হন, আল্লাহপাক যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন সেই প্রার্থনা করি ! আর ছোট ছেলে ইয়াজদান মুক্তাদির মাকে নিয়ে লন্ডনে আছেন)
ভাই- বোন সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন।
সর্বোপরি, মরহুম ম. আ. মুক্তাদির ছিলেন একজন সৎ, খাঁটি দেশপ্রেমিক, যোগ্য নেতা, তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল খুবই সাদাসিদে। লোভলালসার কাছে কোনদিন মাথা নত করেননি। কোন এক সময় তাকে এমপি হওয়ার অফার দেয়া হয়েছিল, তিনি সেটা প্রত্যাখান করেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্তার পক্ষে রাজনীতি করেছেন। এই বিপ্লবী নেতার আদর্শ কি বাংলাদেশে প্রতিস্টিত হবে? আমাদের ভাগ্য খুবই মন্দ; অকালে মরহুম ম. আ. মুক্তাদির আমাদের সবাইকে ছেড়ে এ নিঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। যুগ যুগ ধরে তার চিন্তা, চেতনা, মেধার বিকাশ, আদর্শ ও কর্ম প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে। আল্লাহপাক যেন শ্রদ্ধেয় চাচাকে জান্নাতবাসী করেন সেই প্রার্থনা করি !!