বিলেতের আয়না ডেক্স :- জিয়াউল হক মুক্তা
বাঙালির মহান জাতীয় বীর সিরাজুল আলম খানের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালির বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জনাব খোরশেদ আলম ও মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সিরাজুল আলম খান ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁকে বদলি হতে হয়েছে। সেই সুবাদে সিরাজুল আলম খান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পড়াশোনা করেন।
১৯৬২ সালের নভেম্বরে তিনি আব্দুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা) ও কাজী আরেফ আহমেদকে (পরবর্তীতে জাসদ নেতা) সাথে নিয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রধানত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠন করেন গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ বা নিউক্লিয়াস। পরবর্তীতে এই গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আরো যোগ দেন আবুল কালাম আযাদ (পরবর্তীকালে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা) ও আব্দুল মান্নান (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা)। দারিদ্র্যের কারণে পরে আবুল কালাম আযাদ শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হবার জন্য ও সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য আব্দুল মান্নানকে এই প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়; এঁদের স্থলাভিষিক্ত হন মনিরুল ইসলাম বা মার্শাল মনি (পরবর্তীকালে জাসদ নেতা)।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালের জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শেখ ফজলুল হক মনি। দায়িত্ব গ্রহণের কিছুকালের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ব্যক্তিগত কারণে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল আলম খান। মূলত এই সময়েই তিনি সারা পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতাকামী ছাত্রতরুণদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
১৯৬৩ সালের ৭ নভেম্বরের সম্মেলনে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের মার্চের পর তিনি আরো কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে কারান্তরীণ হন। ১৯৬৫ সালের জুলাই/আগস্ট মাসে কারামুক্তির পরে সেপ্টেম্বরের ৫-৬ তারিখে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ সম্মেলনে তিনি আব্দুর রাজ্জাকের কাছে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন; এসময় তিনি আবুল কালাম আযাদকে দায়িত্ব দেন ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র রচনা করতে। আবুল কালাম আযাদ দু’জন স্কুল শিক্ষার্থীর সহায়তা নিয়ে তা রচনা করেন ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় পাঠ করেন। বর্ধিত সভার পরে ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসমেত ছাত্রলীগ ওই গবেষণাপত্রটি জনবোধ্য পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করে এবং সারা পূর্ব বাংলায় ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ নিয়ে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে।
ছাত্রলীগ কর্তৃক ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ক প্রচার অভিযানের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে ডান-মধ্য-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ইসলামপন্থিরা একে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র বলেন, মস্কোপন্থি কমিউনিস্টগণ একে সিআইএ-র বানানো দলিল ও শেখ মুজিবকে সিআইএ-র দালাল বলেন, চিনপন্থি কমিউনিস্টগণ একে র-এর তৈরি দলিল ও শেখ মুজিবকে ভারতে দালাল বলতে থাকেন। এমনকি আওয়ামী লীগও দল হিসেবে ভেঙে যায়— ছয় দফাপন্থি আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এর আট দফাপন্থি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সকল সিনিয়র নেতৃত্ব শেখ মুজিব ও ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
১৯৬৬ সালেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস বিদ্যুৎগতিতে ছয় দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং ছয় দফাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধানতম অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সিরাজুল আলম খানের সহযোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদ সর্বপ্রথম ছয় দফা সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেন।
ছয় দফা ঘোষণার অপরাধে পাকিস্তানী শাসকরা শেখ মুজিবকে দ্রুত কারান্তরীণ করলে সিরাজুল আলম খান তাঁর মুক্তির দাবিতে ও ছয় দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ধর্মঘট সংঘটিত করেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতা কর্তৃক এই ধর্মঘট আহুত হলেও সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীগণ শ্রমিকদের সাথে নিয়ে এই ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করেন।
ছয় দফা আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিতে সিরাজুল আলম খান শ্রমিক আন্দোলনের ট্রেড ইউনিয়নবাদি ধারা থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের শ্রমিক ফ্রন্ট হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন করেন এবং মস্কোপন্থি ও চিনপন্থি কমিউনিস্টদের কবল থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে উদ্ধার করে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেন।
প্রকাশ্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি ১৯৬৮ সালে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা বিএলএফ। বিএলএফ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জঙ্গিরূপ রূপ দিতে গণআন্দোলনে সীমিত পরিসরে বল প্রয়োগের কাজ শুরু করে।
কারান্তরীত শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বিচার কার্য শুরু করলে সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে মস্কোপন্থি ও চিনপন্থিদের সাথে ১১ দফা ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলেন; মস্কোপন্থিরা ছয় দফায় ঘোষিত পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা মুদ্রার ব্যাপারে একমত না হলে, এই একটি বিষয় বাদ দিয়ে ছয় দফার বাকি সব দফা যুক্ত করে ১১ দফা গ্রহণ করেন। সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের তখন একটাই শপথ, যে কোনো মূল্যে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করতে হবে।
১১ দফার ভিত্তিতে দুর্বার ছাত্র আন্দোলনকে নিউক্লিয়াস ‘ছয় দফা না হলে এক দফা’র (অর্থাৎ স্বাধীনতা)আন্দোলনে পরিণত করেন। এক দফা বা স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার এই পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীগণ গভীর জাতীয়তাবাদি জনপ্রিয় শ্লোগানগুলোর জন্ম দেন; এই সময়ই তাঁরা মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাঙালির জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান প্রবর্তন করেন। বিদ্যুৎগতিতে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পরে।
জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ প্রবর্তনের পর গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত শেখ মুজিবকে অতি দ্রুত ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এককভাবে সম্বর্ধনা প্রদান করে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৬৯-১৯৭০ সালের ছাত্রলীগ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করলেও এর আগেই ১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দেয়ালিকা পত্রিকা ‘প্রতিধ্বনি’তে ছয় দফার পক্ষের একটি রচনায় নিউক্লিয়াসপন্থি ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরি মুশতাক সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের জন্য বঙ্গবন্ধু অভিধাটি ব্যবহার করেন।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রস্তুতিকালে সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার পক্ষের তরুণ নেতৃত্বকে নির্বাচনের প্রার্থী করতে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেন।
১৯৭০ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরুত্তাপ মনে হলেও নিউক্লিয়াস এই সময়টিকে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার দাবি এগিয়ে নিতে বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ‘সার্জেন্ট জহুর বাহিনী’ বা ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করেন ও কুচকাওয়াজ করে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ধর্মঘটটি শ্রমিকদের শহিদ হবার দিন হওয়ায় এদিনে পল্টন ময়দানে শ্রমিক সমাবেশ আয়োজন করা হয়; এতে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। নিউক্লিয়াস ‘ফেব্রয়ারি ১৫ বাহিনী’কে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নাম দিয়ে সামরিক কুচকাওয়াজ করে শহর প্রদক্ষিণ করে সমাবেশস্থলে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁর হাতে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগ হস্তান্তর করেন। পতাকাটি তৈরি করা হয় ৬ জুন শেষ রাতের দিকে, অর্থাৎ ৭ জুন ভোরে। জয়বাংলা বাহিনীর এই রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগটিই পরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে প্রবর্তন করা হয়।
১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের বধির্ত সভায় স্বপন কুমার চৌধুরীর প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াস পরিচালিত আন্দোলনকে সশস্ত্র রূপ দিতে সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের লক্ষ্যে এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে ধাবিত করতে সিরাজুল আলম খান একটি ‘মেগা প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগের নেতা মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনিকে দেড় হাজার প্রশিক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা কর্মীকে পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন, যাঁরা তিন থেকে পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলার প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালান ও নির্বাচনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করেন। ‘জয় বাংলা’ নামের একটি প্রকাশিত ইশতেহারে নির্বাচন বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব ও অগ্রসর জনগণের জন্য করণীয় বিবৃত করা হয়।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে স্বাধীনতাপন্থি নিউক্লিয়াসের সাথে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে নির্দেশ দেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনার জন্য। তিনি এসময় এই চার যুব নেতাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অধিবেশন স্থগিত করলে গণ বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস এই গণবিস্ফোরণকে সুচারুভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করতে থাকে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাসায়নিক পদার্থ ও সমরাস্ত্র লুট ও সংগ্রহ করতে থাকেন। পূর্ব বাংলার প্রতিদিনের সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসারে।
১৯৭০ সালের ৭ জুন যে পতাকাটি জয় বাংলা বাহিনীর রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর করা হয়, হাসানুল হক ইনু সে পতাকাটি রাখতে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদের কাছে। শেখ জাহিদ ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সে পতাকাটি নিয়ে মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আসেন, ছাত্র নেতা আসম আব্দুর রব সেই পতাকাটি জনগণকে প্রদর্শন করেন।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নিউক্লিয়াসপন্থিদের উদ্যোগে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে নিউক্লিয়াসপন্থিদের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটে।
সবশেষে ১ মার্চ সূচিত অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সারাদেশে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কবর রচনা করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণের উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ হাতে ঝাঁপিয়ে পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
অপারেশন সার্চলাইট’ যে কয়েকজন ব্যক্তির ‘হোয়্যারঅ্যাবাউট’ তাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে, সেই তালিকায় পাঁচ নম্বরে ছিলো সিরাজুল আলম খানের নাম।
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। প্রথাগত সামরিক কায়দায় মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। ১১টি সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি চারটি সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ। বিএলএফ-এর চার সেক্টরের একটি সেক্টর পরিচালনা করেন সিরাজুল আলম খান নিজেই; তাঁর ডেপুটি ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। সকল সেক্টরের জন্য দেরাদুনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন হাসানুল হক ইনু। অক্টোবর থেকে বিএলএফ মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হতে থাকে। দেশের অনেক অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী একসাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে, কোথাও কোথাও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পরপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারা এগিয়ে নিতে সিরাজুল আলম খান প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন কাজী আরেফ আহমেদ।
কিন্তু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে উদ্ভব হলো অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি।
এক. ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর— সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুর হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ— বিএলএফ/মুজিব বাহিনীর ৪ নেতার সাথে বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষৎ বিষয়ে ৪ দফা ঐকমত্যে উপনীত হন। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে ৩১ জানুয়ারি বিএলএফ/মুজিব বাহিনী অস্ত্রসমর্পন করেছিল। বঙ্গবন্ধু এই চার দফা ঐকমত্য অনুসরণ করেননি।
দুই. বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানের কাছে দেশ পুনর্গঠনে ছাত্র-যুব সমাজের সুপারিশ জানতে চাইলে জানুয়ারি মাসেই সিরাজুল আলম খান তাঁকে একটি ১৫ দফা সুপারিশনামা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু এই সুপারিশনামা অনুসরণের কোনো উদ্যোগ নেননি।
তিন. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুতিকাগার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের ১৯৭২ সালের ৫—৭ মার্চের সাধারণ সভা ও ১৯—২৩ মার্চের বর্ধিত সভায় [ক] রাজনৈতিক, [খ] শিক্ষা, [গ] সাংগঠনিক ও [ঘ] বিবিধ প্রস্তাবনায় সতর্ক করে বলা হয়েছিল যে ছাত্রযুব সমাজের পরামর্শ না মানলে দেশের ভবিষৎ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাস্তবে তাই হয়েছিল।
চার. ১৯৭২ সালের ১ মে জাতীয়করণ নীতি ঘোষণার বেতার-টেলিভিশন ভাষণে এবং ৭ মে ডাকসু কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে আয়োজিত সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিষয়ে কিছু অঙ্গীকার করেছিলেন, যা ছিল ১৯৭০ এর নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রায় অনুরূপ। তিনি তার অঙ্গীকারের পথে এগুতে পারেননি।
পাঁচ. ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজের পক্ষে আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া ১৯৭২ সালের ২৫ মে “জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করতে হবে” শীর্ষক একটি বিবৃতিতে ১২ দফা সুপারিশমালা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু এই সুপারিশমালাও গ্রহণ করেননি।
ছয়. ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ধর্মঘটের দিবস ১৯৭২ সালের মহান স্বাধীকার দিবস ৭ জুন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় উপরে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো না মানলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কী কী বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে জাতিকে অবহিত ও সতর্ক করা হয়েছিল। এই সতর্কতামূলক মিনতি বঙ্গবন্ধু বিবেচনা করেননি।
সাত. ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্ধিত সভার শেষ দিন ২১—২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণার পর— ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির কেবলমাত্র স্বায়ত্তশাসনপন্থি ৭/৮ জন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর স্পষ্টরূপ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ যে ৩৭/৩৮ জন— সে ৩৭/৩৮জনকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দিয়ে ৭/৮ জন পল্টন ময়দানের বিপরীতে রেসকোর্স ময়দানে পাল্টা সম্মেলন ও কাউন্সিল আহ্বান করলে, বঙ্গবন্ধু ২০ জুলাই গভীর রাত পর্যন্ত কোন সম্মেলনেই যাবেন না বলেও ২১ জুলাই সকালে রেসকোর্সে গেলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থিদের বর্জন করে বঙ্গবন্ধু তিনি ১৯৭০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা স্বায়ত্তশাসনপন্থি ছিলেন, তাদের সম্মেলন ও কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
আট. উপরে এক, দুই, তিন, পাঁচ ও ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্ত সুপারিশ/দাবি/সতর্কতার বিরুদ্ধে সাত নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংখ্যালঘু ছাত্র-যুব নেতৃত্ব এবং চিনপন্থি ও মস্কোপন্থি রাজনীতির অনুসারীগণ পত্রিকায় প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের কথা রেখেছেন।
নয়. শুধু তাই নয়, ১৯৭০ পর্যন্ত যারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন না করে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষ নিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ক্ষণ থেকেই তারা ১৯৬২ সাল থেকে যারা স্বাধীনতার আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছেন তাঁদেরকে হত্যা করতে থাকেন। যেমন বলা যায়, ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরীর কথা, ১৯৭০ সালের সম্মেলনে যাঁর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হবার কথা ছিল এবং যিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের বধির্ত সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাবক, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সেই যুদ্ধাহত স্বপন কুমার চৌধুরীকে হাসপাতাল থেকে অপহরণ করে গুম করা হয়; একদিন পর তাঁর সুশ্রুষাকারী নার্সকেও অপহরণ করে গুম করে ফেলা হয়। এরকম হত্যাকাণ্ডের ধারা অব্যাহত থাকে, এবং এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে যে পরিমাণে নামি দামি স্বাধীনতা আন্দোলনকারী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে. বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সামরিক, বেসামরিক বা স্বাধীনতাবিরোধীদের সরকারের হাতেও সেই পরিমাণ বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করা হয়নি।
দশ. স্বাধীনতাপন্থিদের হত্যার পাশাপাশি পাকিস্তান আমলের এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন)-এর গুন্ডাপান্ডাদের দিয়ে স্বায়ত্তশাসনপন্থিগণ গঠন করেন জাতীয় যুবলীগ। এরা এমনকি ১৯৭২ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কৃষক লীগের সভাগুলোতেও প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে সারা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসর নেতাকর্মীদের হত্যা করতে থাকেন।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে যুদ্ধফেরত স্বাধীনতা আন্দোলনের সারা দেশের অগ্রসর নেতাকর্মীদের তীব্র দাবি ও চাপের মুখে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দকে সামনে রেখে গঠন করেন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। জাসদ গঠনকারীগণ ক্ষমতার মায়া-মোহ-লোভ-লালসাকে পায়ে দলে ক্ষমতাসীন দল পরিত্যাগ করে আন্দোলনের পথ গ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদ হলো শতভাগ মুক্তিযোদ্ধার দল।
সিরাজুল আলম খান ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠনে বাধ্য হলেও তাঁর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি কখনো। জাসদের আন্দোলন-সংগ্রাম চলাকালেও তাঁদের দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল।
জাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সিরাজুল আলম খান ও অপরাপর জাসদ নেতৃত্বকে আওয়ামী ঘরানার অনেকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সিরাজুল আলম খান ও জাসদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারভিত্তিক অপপ্রচারে লিপ্ত হন। অথচ উপরোক্ত দশটি অনুচ্ছেদে দেখানো হয়েছে কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির অগ্রসর নেতাকর্মীদের আওয়ামী ঘরানা থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়; আওয়ামী ঘরানার অভ্যন্তরে থেকেও তারা ব্যাপকভাবে হত্যা-খুন-গুমের শিকার হচ্ছিলেন; রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি আত্মরক্ষার জন্য আলাদা পরিচয়ের প্রয়োজনও তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে ওঠেছিল। আজও পর্যন্ত উল্লিখিত বিষয়গুলোতে আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিবর্গ এক লাইনের জবাবও দিতে পারেন না।
আওয়ামী ঘরানার অনেকে এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য সিরাজুল আলম খান ও জাসদের অপরাপর নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগ ত্যাগকে দায়ী করেন। কিন্তু সত্যিকারের ব্যাপার হলো আওয়ামী রাজনীতি একদিকে যেমন স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসর নেতাকর্মীদের দল থেকে বের করে দিয়েছিল, অন্য দিকে তারা নিজেরাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেছিল।
এক. স্বাধীন দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তর ব্যাহত করতে বঙ্গবন্ধুর নিজের মনোনীত বিএলএফ/মুজিববাহিনীর ৪ নেতার ৪ সুপারিশ [ইতোমধ্যে মুজিব বাহিনীর চার যুব নেতা আর ঐকমত্যে নেই; তারা বিভক্ত হয়েছেন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন] আর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণ করা থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করা হলো ।
দুই. সরকারি প্রতিবেদনের প্রগতিশীল পরামর্শ উপেক্ষা করে জনপ্রশাসনের বৈপ্লবিক রূপান্তর না করে জনপ্রশাসনে পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসন ও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলো।
তিন. পুলিশ ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থায় পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত ও তাদের কাছে কর্তৃত্ব প্রদান করা হলো।
চার. সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।
পাঁচ. রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে হাজার হাজার বীর-মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হলো জেলে আর হাজার হাজার পাকহানাদার-দালাল কারামুক্ত হয়ে সমাজে বিচরণ করতে লাগলো অবাধে।
ছয়. ১৯৭২ সাল থেকেই দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাস-কালোবাজারি-মজুদদারি-পাচারকারি-রেশনবাজির মহোৎসব অব্যাহত রইলো; দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের কথা বলেছিলেন; বলেছিলেন, আমার কম্বল কই?
সাত. ১৯৭৪ সালে— বৈশ্বিক পরিসরে মূল্যস্ফীতি, দেশজ পরিসরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, আর বঙ্গবন্ধু-কথিত চাটার দল ও চোরের দল ও নরপশুর দলের দুর্নীতির ফলে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকার পরও দেশে দুর্ভিক্ষ হলো; মানুষ মারা গেল— সরকারি হিসেবে ২৭,০০০ থেকে ৩৭,০০০ জন। বঙ্গবন্ধু নিজেই তা স্বীকার করেন।
আট. বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিবর্তনমূলক বিভিন্ন কালাকানুন প্রবর্তিত হলো।
নয়. ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হলো। জাসদের বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীকে পরাজিত করতে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ব্যালট বাক্স এনে পরে খন্দকার মোশতাককে বিজয়ী করা হলো। বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বিকে অপহরণ করে নমিনেশন জমা দিতে দেয়া হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হলো; প্রার্থী অপহরণ ও ভোট ডাকাতি হলো, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। ১৯৭৪ সালে জাসদ কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়া হলো আর দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয় তছনছ করা হলো।
দশ. শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যাপ-সিপিবি আওয়ামী লীগ সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলো ও বাকশালে বিলুপ্ত হলো। চীনপন্থি দলগুলো গোপনে বিরোধিতা করলো শ্রেণিশত্রু খতমের বিভ্রান্তিকর রাজনীতির মাধ্যমে। প্রকাশ্য অপর সকল দল সরকার বিরোধী জোট গঠন করলেও কোন ভূমিকা রাখতে পারলো না। আর প্রকাশ্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জাসদ ছিল একা।
এগারো. একক জাতীয় দল ও কর্মসূচির ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা কায়েম করা হলো নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর রাষ্ট্রপতির একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে; অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলো; চারটি বাদে অন্যসব পত্রিকা নিষিদ্ধ হলো। গণকণ্ঠ নিষিদ্ধ হলো; নিষিদ্ধ জাসদ অপ্রকাশ্যে ও গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলো।
বারো. বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলো; মার্কিনীদের পুরোনো দিনের বঙ্গবন্ধু বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রইলো ও শক্তিশালী হলো—মোশতাকের পেয়াদা রশিদ-ফারুকচক্রের কাছে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গ্রিন সিগনাল গেল এভাবে যে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না ও তৎকালীন সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেন। এর মধ্যে জিয়াও সিআইএ-র সাথে অনুষ্ঠিত দুটো সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের সম্মতি পেয়ে যান; বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় মাস আগেই এ হত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
হয়তো এই সব নয়; বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপটে হয়তো যোগ করার আছে আরও অনেক কিছু। এবারে দেখা যাক বর্ণিত প্রেক্ষাপটে কোন কুশীলব-চক্র সাড়ে তিন বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ও তাঁকে হত্যার উল্লিখিত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন—
এক. আওয়ামী রাজনীতিতে শেখ মনির অনুসারীগণ; যদিও ১৫ আগস্ট শেখ মনিরও মৃত্যু হয়েছে— তার মত-পথ-জন ও ক্ষমতালিপ্সায় গৃহীত কার্যক্রম তাকেই দুর্বল করেছে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলা করেছে।
দুই. আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের অনুসারীগণ। শেখ মনি উপদলের সাথে এ উপদলের দ্বন্দ-বিরোধে দুর্বল হলো উভয় উপদল।
তিন. খন্দকার মোশতাকের অনুসারীগণ। তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতা করতে গিয়ে শেখ মনির উপদল এ উপদলের সাথে আঁতাত করলো।
চার. জনপ্রশাসনে পাকিস্তান আমলের ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের কর্তৃত্বাধীন পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
পাঁচ. পুলিশ ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
ছয়. সশস্ত্র বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
সাত. মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ঔপনিবেশিক সেনাকাঠামোর ক্ষমতালিপ্সু বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাগণ।
আট. বাকশালে বিলীন সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির অনুসারীগণ।
নয়. ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ— বিশেষত কেজিবির কর্মকর্তাগণ, যারা ন্যাপ-সিপিবিকে সরাসরি অর্থায়ন করেছে ও শেখ ফজলুল হক মনিকে সমর্থন করেছে।
দশ. ঢাকায় বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ ও সিআইএ’র কর্মকর্তাগণ, যারা যথাক্রমে মোশতাকের অনুসারীদের ও জিয়াকে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় সবুজ সংকেত দিয়েছেন।
বলে রাখা প্রয়োজন, সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠনের পর বারবার বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু সেসব বিশ্বাস করেন নি; বরং তিনি সিরাজুল আলম খানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে আর তার নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বলে জানান, এবং দেশ ত্যাগ করতে বলেন। সিরাজুল আলম খান দেশ ত্যাগ করার পর প্রশাসন থেকে তাঁর পাসপোর্ট বাতিল ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, সিরাজুল আলম খান তখন কলকাতায় চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর জেনে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
সিরাজুল আলম খানের দল জাসদ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাকশালে বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও সিপিবির সকলে যখন কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে সক্ষম হননি, তখন জাসদ-ইউপিপি-জাগমুই খন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেন, বিবৃতি দেন, লিফলেট আকারে ছাপিয়ে সেই বিবৃতি প্রচার করেন। পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে জাসদ নেতাকর্মীগণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় মোশতাক সরকারের হাতে খুন হন। এমনকি খন্দকার মোশতাকের বাসভবন এলাকা পুরোনো ঢাকার আগামসিহ লেনে জাসদের সশস্ত্র সংগঠন বিপ্লবী গণবাহিনীর সদস্যগণ বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করেন।
জাসদ বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করলেও, বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দক্ষিণপন্থার উত্থান সূচিত হয়, তার বিরুদ্ধে একদম শুরু থেকেই সচেতন ছিল। সেজন্যই জাসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনতে ১৯৭৫ সাল থেকে বারবার আওয়ামী লীগ ও জাসদের ঐক্যের উপর জোর প্রদান করেছে। সিরাজুল আলম খান জাসদের এই অবস্থানের বিরোধীতা করেন নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যা-খুনের রাজনীতি ও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর যে উচ্ছৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলার সূচনা হয়, তার ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর আরো একটি ক্যু সংগঠিত হয়, যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিরাপদে প্লেনে তুলে দিয়ে দেশ ত্যাগের সুযোগ করে দেয়।
সেনাবাহিনীতে অফিসারদের এরকম ক্যু ও পাল্টা ক্যুর প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। জাসদের নীতি নির্ধারখ হিসেবে সিরাজুল আলম খান সেই সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানকে অনুমোদন দেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সে অভ্যুত্থান বানচাল করা হয়; অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সিরাজুল আলম খানসহ জাসদ নেতৃত্বকে কারান্তরীণ করা হয়।
কারাগারে সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক চিন্তা ও মানসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে নিজের রচনায় তিনি মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি উপরকাঠামোর সাথ সহযোগিতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। অ্যাডভোকেসি কৌশল হিসেবে হিসেবে তার চিন্তা আধুনিক হলেও, রাজনীতিতে তা সংগ্রামী ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ফলে ১৯৮২ সালে সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন হলে সিরাজুল আলম খান মাঠের আন্দোলনের পাশপাশি রাষ্ট্রের উপরকাঠামোর সাথে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন। সিরাজুল আলম খানের অনুসারীগণ মাঠের আন্দোলনের প্রতি অবিচল থাকেন; জাসদ রাজনীতির সাথে তাঁর বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়; যদিও পরে জাসদত্যাগী আসম আব্দুর রব আবারও জাসদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন ও সিরাজুল আলম খান ও সামরিক জান্তা এরশাদের সমর্থন পান। সিরাজুল আলম খান উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তনসমেত বিভিন্ন সংস্কারে সামরিক শাসককে প্রভাবিত করেন।
পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সিরাজুল আলম খান অ্যাকাডেমিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিনি অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র নামে যে ধারণার প্রবর্তন করেন, তা মূলত অপরাপর পেশাগোষ্ঠির পাশপাশি অনগ্রসর দেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে অতিশক্তিশালী ঔপনিবেশিক সামরিক বাহিনীর অবৈধ অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করে।
এরশাদ সামরিক শাসনের অবসানের পর তিনি উপআঞ্চলিক সহযোগিতা, একুশ শতকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে কতিপয় প্রস্তাবনা হাজির করেন। এসব প্রস্তাবনা নতুন কোনো রাজনৈতিক তত্ত্ব নয়, এগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অনুসৃত। এমনকি তিনি সর্বশেষ পেশাভিত্তিক জাতীয়তার যে ধারণা উপস্থাপন করেন, সেই ধারণাও জাতি গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোকে অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। মোটকথা, সিরাজুল আলম খান সাধারণভাবে তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি কখনোই তা ছিলেন না। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ে তিনি প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করলেও এবং এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ছয় প্রেক্ষাপট প্রদান করলেও, সে আঞ্চলিক বৈষম্যের তত্ত্বায়ন করেছিলেন আবুল কালাম আযাদ। জাসদ প্রতিষ্ঠার প্রধান তাত্ত্বিকও তিনি ছিলেন না; জাসদের তাত্ত্বিক ভিত্তি এসেছিল নিউক্লিয়াসের কনিষ্ঠতম সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক বলয় থেকে এবং পরবর্তীতে ড. আখলাকুর রহমানের ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ শিরোনামের গবেষণা থেকে। জাসদ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে তিনি হাজার হাজার স্বাধীনতা আন্দোলনকারীর আকাঙ্ক্ষার প্রতি সাড়া দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরচিালনাকালে মস্কোপন্থি ও চিনপন্থিদের সীমাবদ্ধতার পর্যবেক্ষণ জাসদকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি নির্মাণে সহযোগিতা করেছে।
সিরাজুল আলম খান ছিলেন বাঙালি জাতির মহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম সংগঠক; তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধানতম সংগঠক; তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রধান; তিনি বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্টতম শিষ্য ও সহযোদ্ধা।
মনে রাখতে হবে যে সিরাজুল আলম খান তাঁর চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করেছেন, লিখেছেন; কিন্তু তিনি কখনোই কোন ধরনের ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়া দ্বারা তাড়িত হননি। তাঁর কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, আত্মীয়স্বজন ও সহযোদ্ধা-অনুসারীদের আশ্রয়ে থেকেছেন; তিনি চিরকুমার ছিলেন; বিশ্বের সকল বাঙালিকে নিয়ে তাঁর পরিবার।
*জিয়াউল হক মুক্তা, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।