মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ

বিলেতের আয়না ডেক্স :- আনোয়ার শাহজাহান

মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বর্বর পাকবাহিনী রাতের অন্ধকারে বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালালে দেশের প্রতিটি এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। গোলাপগঞ্জের জনগণও পিছিয়ে ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ গোলাপগঞ্জে এসে পৌঁছলে শত শত মানুষ রাতভর গোলাপগঞ্জ ও ঢাকাদক্ষিণে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই সিলেট শহর থেকে শত শত লোক প্রাণভয়ে গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আসতে থাকে। মুক্তিসংগ্রামী গোলাপগঞ্জবাসীরা শরণার্থীদের মাঝে খাবার ও পানি সরবরাহসহ তাদের থাকার ব্যবস্থা করে।

মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জ উপজেলার রয়েছে বিরল ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনে জানমাল ও মেধা দিয়ে উপজেলার ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যুব ও তরুণ সমাজ দলে দলে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। প্রবাসী গোলাপগঞ্জবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনমত গঠন এবং অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেন।
স্বাধীনতাকামী সৈনিকরা যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। উপজেলার ফুলবাড়ী মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে স্থাপিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এলাকার ছাত্র ও যুব সমাজকে অস্ত্র মহড়া, আক্রমণ ও শত্রুদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ছুটে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন ইপিআরের কয়েকজন জোয়ান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুবেদার মতিউর রহমান এবং হবিলদার আবু আহমদ। এখান থেকে যোগাযোগ করা হত বিয়ানীবাজারের মেওয়া ক্যাম্পে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট এটি পরিচালনা করছিল, আর কিছুদিন তার দায়িত্বে ছিলেন গোলাপগঞ্জের কৃতিসন্তান মেজর জেনালের আজিজুর রহমান (ছত্রিশ রাণাপিং)। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে কাজ করেন মরহুম আব্দুর রহিম অ্যাডভোকেট (সাবেক এমপি), মসুদ আহমদ চৌধুরী (রণকেলী), কফিল উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী), ইকবাল আহমদ চৌধুরী (রফিপুর), আব্দুল জববার (বারকোট), সৈয়দ মকবুল হোসেন (সুন্দিশাইল), শহীদ লে. কর্ণেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী (রণকেলী), জয়নাল মহসীন চৌধুরী (ভাদেশ্বর) প্রমূখ।

মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রথমেই গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ী ইউনিয়নের বইটিকর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ৮ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিলেট শহর পূর্ণ দখল করে ফেলে। এসময় মুক্তিসেনারা কৌশল গ্রহণের জন্য ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হন। একটি শেরপুর হয়ে মৌলভীবাজারের দিকে পিছু হটে, একটি খাদিমনগর জৈন্তা হয়ে তামাবিলের দিকে অগ্রসর হয় এবং অপরটি গোলাপগঞ্জ বইটিকর এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে।

পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট শহরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তাদের একটি গ্রপ গোলাপগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে বইটিকরে অবস্থান নেয়া মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। এসময় লড়াই বেঁধে গেলে অনেকেই হতাহত হন। গোলাবারুদ, অস্ত্র এবং সৈন্যবল তুলনামূলক কম থাকায় মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা বইটিকর এলাকা ত্যাগ করে।

১০ এপ্রিল বিয়ানীবাজারের মেওয়া থেকে ফুলবাড়ী মাদ্রাসায় স্থাপিত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রাকযোগে খাবার নিয়ে আসা হচ্ছিল। ট্রাকটির সঙ্গে ছিলেন ফুলবাড়ীর লাল মিয়াসহ ৪ জন আনসার। গাড়িচালক ছিলেন জকিগঞ্জের বাসিন্দা এখলাছ হোসেন (ছুতু মিয়া)। খাদ্য বহনকারী ট্রাক ছাড়াও রাস্তায় কয়েকটি ট্রাক ও গাড়ি চলাচল করছিল। হঠাৎ খাদ্যবাহী ট্রাককে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়তে থাকে পাকিস্তানি বোমারু বিমান। গোলাপগঞ্জের মৌলভীর খাল নামক কালভার্টের নীচে আত্মগোপন করার জন্য গাড়ি থেকে নামার আগেই পাকবাহিনীর ছোঁড়া বোমায় খাদ্যবাহী ট্রাকটি বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং শহীদ হন ফুলবাড়ী এলাকার কিশোর মতিউর রহমান, মোহাম্মদপুরের ভেড়াই মিয়া ঠিকাদার, সাইদুর রহমান ও গাড়িচালক জকিগঞ্জ উপজেলার এখলাছ হোসেন (ছুতা মিয়া)। বোমার আঘাতে লাল মিয়ার ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকবাহিনীরা এখান থেকে এগিয়ে রাণাপিং এলাকায় পৌঁছে আওয়ামী লীগ নেতা কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও হারুন চৌধুরীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে গুলি করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পাকবাহিনীর ১০ জন সৈন্যের মধ্যে কারো কাছে গুলি না থাকায় অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের উপর এবং রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে চলে যায় হানাদার বাহিনী।

উপজেলার বইটিকরে ক্যাপ্টেন আজিজ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সেনা, ইপিআর ও আনসার মুজাহিদের প্রায় ৩০০ জনের একটি দল পাকবাহিনীর সাথে ২৪ এপ্রিল এক সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদের সহযোগিতা করেন সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে আসা প্রায় ৩০০ বিএসএফ-এর একটি দল। আধ ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকবাহিনীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

২৬ এপ্রিল সকালে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল উপজেলার ঢাকাদক্ষিণে প্রবেশ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও হিন্দুধর্মালম্বীদের খুঁজতে থাকে। এসময় পাকবাহিনী স্থানীয় ব্যাংক, দোকানপাট লুটপাট করে। এছাড়া শ্রী চৈতন্য দেবের মন্দির ও দত্তরাইল গ্রামের কালিকৃষ্ণ চৌধুরীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে লুটপাট করে। একইদিন বারকোট গ্রামের মনোরঞ্জন চক্রবর্তী নিতাইকে হত্যা করে। মুক্তিকামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকাদক্ষিণ পাকহানাদার বাহিনীমুক্ত হয় এবং একইদিন মুকিতলা গ্রামের ছানুহর আলীকে পাক ও রাজাকার বাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম সংগঠন ঢাকাদক্ষিণ সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ ২০১২ সাল থেকে ১১ ডিসেম্বর ঢাকাদক্ষিণ মুক্ত দিবস পালন করে আসছে।

১২ সেপ্টেম্বর গোলাপগঞ্জের সীমান্তসংলগ্ন হাকালুকী হাওড়ে চলে দুর্ধর্ষ এক অপারেশন। ৪ নং সেক্টরের কুকিতল সাবসেক্টরের ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল খায়ের চৌধুরী, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা তজম্মুল আলী ও লুৎফুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি বড়লেখার ডিমাই গ্রামে অবস্থানের পর ফেঞ্চুগঞ্জ থানার চান্দভাগ চা-বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার আগেই ভোর হয়ে যায়। এসময় একটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিতে গেলে সংবাদ পেয়েই তাদের উপর আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। এসময় মুখোমুখী সংঘর্ষে ২৫ জন পাকবাহিনী নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর ৩ জন জোয়ান শহীদ হন।

২৫ অক্টোবর (৪ রমজান) বারপুঞ্জি ক্যাম্প থেকে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল উপজেলার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামে এসে পৌঁছে বিশ্রাম নেন। মুক্তিযোদ্ধার আগমনের সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর এক দোসর এ সংবাদটি পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। এসময় পাকসেনারা এলাকায় আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা নিরীহ এলাকাবাসীর কথা চিন্তা করে পাল্টা আক্রমণ না করে পাশ্ববর্তী টিলা দিয়ে সুন্দিশাইল এলাকা ত্যাগ করেন। মুক্তিবাহিনীকে না পেয়ে স্থানীয় এক রাজাকারের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীদের আশ্রয়দাতাদের মধ্যে এলাকার ১৭ জন নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। তাদেরকে হত্যা করার জন্য স্থানীয় মোকামটিলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। এ সুযোগে আটককৃত লোকজন পালিয়ে গিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা পাল্টাপাল্টি আক্রমণে শহীদ হন দু’জন এবং আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

পরদিন ২৬ অক্টোবর (৫ রমজান) মোকামটিলায় অবস্থিত হযরত জাহান শাহ্ মৌলার মাজারসংলগ্ন মসজিদে (উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জড়ো হওয়া) মুসুল্লিরা আসরের নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। এসময় পাকবাহিনীর স্থানীয় এক দোসরের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা গণহত্যা চালিয়ে একসাথে শহীদ করে ২১ জন রোজাদার সাধারণ মুসুল্লিকে। এ ২১ জন শহীদের মধ্যে কেউই মুক্তিবাহিনীর সদস্য না হলেও দেশ স্বাধীনের রণাঙ্গনের সাথে তাদের কারো সন্তান বা কারো আত্মীয়-স্বজন জড়িত ছিলেন। ২৫ ও ২৬ অক্টোবর সুন্দিশাইল মোকামটিলায় আক্রমণ চালিয়ে দু’দিনে ২৩ জনকে শহীদ করে পাকবাহিনী। নির্মম এ গণহত্যাটি ছিল গোলাপগঞ্জ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় গণহত্যা।

আরও পড়ুন:  মাটি ও মানুষের বন্ধু আনোয়ার শাহজাহান - মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার

মোকামটিলায় পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণে নির্মমভাবে যারা শহীদ হয়েছেন তারা হলেন – (১) শহীদ খুর্শেদ আলী (সুন্দিশাইল), পিতা সরাফত আলী লস্কর (২) শহীদ আসদ আলী (সুন্দিশাইল), পিতা আব্দুল হামিদ (৩) শহীদ তুতা মিয়া (সুন্দিশাইল), পিতা আব্দুল মজিদ মাস্টার (৪) শহীদ চাঁন্দ মিয়া (সুন্দিশাইল), পিতা মছির আলী (৫) শহীদ মুবেশ্বর আলী (সুন্দিশাইল), পিতা ইদ্রিছ আলী (৬) শহীদ কুটু চাঁন্দ মিয়া (সুন্দিশাইল), পিতা আইয়ূব আলী (৭) শহীদ ওয়ারিছ আলী (সুন্দিশাইল), পিতা ওয়াজিদ আলী (৮) শহীদ মস্তন আলী (সুন্দিশাইল), পিতা মজর আলী (৯) শহীদ ওহাব আলী (সুন্দিশাইল), পিতা জছির আলী (১০) শহীদ সুনু মিয়া (সুন্দিশাইল), পিতা রশিদ আলী (১১) শহীদ সমুজ আলী (সুন্দিশাইল), পিতা ওয়াজিদ আলী (১২) শহীদ মাতাই মিয়া (সুন্দিশাইল), (১৩) শহীদ আনু মিয়া (সুন্দিশাইল), পিতা আব্দুল গনি (১৪) শহীদ কুটলা মিয়া, (সুন্দিশাইল), (১৫) শহীদ মুতলিব আলী (কালিডহর, চন্দরপুর), পিতা মিজান আলী (১৬) শহীদ মানিক মিয়া (সুন্দিশাইল), (১৭) শহীদ চুনু মিয়া (কালিডহর, চন্দরপুর), পিতা জহির আলী (১৮) শহীদ খালিক মিয়া (সুন্দিশাইল), (১৯) শহীদ লুলু মিয়া (মীরগঞ্জ, ভাদেশ্বর), পিতা মুজম্মিল আলী। অপর চারজন শহীদের নাম ও ঠিকানা এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। (গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে সুন্দিশাইলে ২৩ জন শহীদের মধ্যে ১৮ জনের নাম সংগ্রহ করেছিলাম। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সুন্দিশাইল গ্রামে শহীদদের স্মরণে গঠিত সুন্দিশাইল ২৩ শহীদ স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক ফয়ছল আলম ও স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ ওয়াদুদ এমরুলের প্রচেষ্টায় ২০১৩ সালে ভাদেশ্বর শেখপুর গ্রামের শহীদ লুলু মিয়ার পরিচয় সংগ্রহ করা হয়। তাঁর মুক্তিবার্তা নম্বর ০৫০১০৩০০৪৪)।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আবুল খায়ের চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা সুতারকান্দি-বিয়ানীবাজার হয়ে ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের নালিউরী গ্রামে এসে অবস্থান নেন। বীর সন্তানদের উপস্থিতিতে গ্রামবাসী আনন্দিত হয়ে তাঁদের আহার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নালিউরী গ্রাম থেকে মাত্র দেড় মাইল উত্তরে ঢাকাদক্ষিণ বাজারে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। বিকেল বেলা রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর আগমনের সংবাদটি পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিসেনাদের ধরে নেয়ার জন্য পাকবাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক রাজাকারদের বড় একটি গ্রুপ নালিউরি গ্রামে প্রেরণ করে। রাজাকারদের আগমনের খবর পেয়ে তাদের প্রতিহত করতে মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে পড়েন। বাংলার বীর জোয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়ে রাজাকাররা বুঝতে পারে এ মুহূর্তে তাদের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। মুক্তিবাহিনী চারদিকে তাদের ঘিরে ফেলায় পালাবারও পথ পায়নি তারা। এখন মৃত্যু তাদের অবধারিত। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে স্থানীয় একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়ে প্রাণভিক্ষা চায় রাজাকাররা। তৎকালীন ভাদেশ্বর ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নোমান আহমদ চৌধুরী শর্তসাপেক্ষে তাদের মুক্ত হওয়ার সুপারিশ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেন। যা পরবর্তী অপারেশনে কাজে আসে। এছাড়া যুদ্ধের শুরুতেই খাদ্যাভাব দেখা দিলে গোলাপগঞ্জ খাদ্যগুদামে এক অপারেশন পরিচালনা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তালা খুলে অন্তত চার ট্রাক শুকনো খাবার নিয়ে রাখা হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কফিল উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে। এখান থেকেই চাল, মুড়ি, চিড়া, গুড় ও পানি গুলো সরবরাহ করা হত অভূক্ত মানুষদের মাঝে।

৬ ডিসেম্বর কুকিতল সাবসেক্টর থেকে অপর একটি গ্রুপ বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকুল হক পানির নেতৃত্বে গোলাপগঞ্জ হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক ঘাঁটি ছেড়ে ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। এসময়ই গোলাপগঞ্জের অধিকাংশ এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। এমতাবস্থায় পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে একটি কনভয় ভাদেশ্বরের মোকামবাজারের দিকে ছেড়ে যায়। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় মাইন স্থাপন করে প্রস্তুতি নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকবাহিনীর কনভয়টি আসার সাথে সাথে পুঁতে রাখা মাইনটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলে ১ জন পাকসৈন্য মারা যায় ও বাকি ১২ জন পালিয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ৩৮ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে গোলাম নুরানী চৌধুরী উপজেলার ভাদেশ্বর এলাকায় যাওয়ার পথে নালিউরী এলাকায় পাকসেনাদের একটি গাড়ি উড়িয়ে দেন। ১২ ডিসেম্বর ভোরে পাকসেনারা গোলাপগঞ্জ ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে গেলে গোলাপগঞ্জের মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা গোলাপগঞ্জ চৌমুহনীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

সারা দেশের মতো এভাবেই পাকবাহিনীমুক্ত হয় গোলাপগঞ্জ। পরাজিত পাকবাহিনী অবশেষে পলায়ন করে থানা ছেড়ে তারা সিলেট শহরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারেনি। ত্রিমুখী আক্রমণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। একের পর এক অঞ্চল পাকবাহিনী থেকে মুক্ত হতে থাকে গোলাপগঞ্জ, সিলেট ও ঢাকা। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্র।

বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিণত করতে অনেকেই বিসর্জন দিয়েছেন তাদের প্রাণ। মা-বোনরা হারিয়েছেন তাদের সম্ভ্রম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন অনেক কৃতিমান ব্যক্তি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য মুক্তিযোদ্ধাগণকে বিভিন্ন ধরণের পদক প্রদান করা হয়েছে। এই পদক সমূহ কয়েক স্তরে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে: (১) বীর শ্রেষ্ঠ, (২) বীর উত্তম, (৩) বীর বিক্রম, (৪) বীর প্রতীক ।

বীর শ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচচ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্নত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতি স্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ৭জন মুক্তিযোদ্ধাকে এই পদক দেয়া হয়েছে ।
বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের অন্যান্য পদক হল, গুরুত্বের ক্রমানুসারে, বীর উত্তম (৬৮ জন), বীর বিক্রম (১৭৫ জন), বীর প্রতীক (৪২৬ জন) । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরই এই পদকগুলো দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক বাংলাদেশ গেজেট-এর অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই পদক প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত গোলাপগঞ্জের কৃতিসন্তান
বীর উত্তম
১। মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আজিজুর রহমান (ছত্রিশ রাণাপিং)
২। অনারারী ক্যাপ্টেন (অব.) আফতাব আলী (ভাদেশ্বর দক্ষিণভাগ)
৩। শহীদ নায়েক শফিক উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী)

বীর বিক্রম
১। মেজর (অব.) শমসের মুবিন চৌধুরী (ভাদেশ্বর, দক্ষিণ ভাগ)
২। সুবেদার মেজর (অব.) ফখর উদ্দিন চৌধুরী (রণকেলী)
৩। শহীদ হাবিলদার জুম্মা মিয়া (হেতিমগঞ্জ)
৪। ইয়ামিন চৌধুরী (রণকেলী)
৫। শহীদ কনেস্টবল মো. তৌহিদ (চৌধুরী বাজার)
৬। অনারারী কাপ্টেন (অব.) তাহের আলী (মাইজভাগ)

বীর প্রতীক
১। জিএন ফখর উদ্দিন চৌধুরী (ফুলবাড়ী)
২। নায়েক আব্দুল মালিক (নগর, ঢাকাদক্ষিণ)
৩। কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম (বরায়া উত্তরভাগ)
৪। নানু মিয়া (দাড়িপাতন)

তথ্যসূত্র: গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য – আনোয়ার শাহজাহান।

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top