মাটি ও মানুষের বন্ধু আনোয়ার শাহজাহান – মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার

বিলেতের আয়না ডেক্স :- মাটি ও মানুষের বন্ধু আনোয়ার শাহজাহান – মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার

আনোয়ার শাহজাহানের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় হওয়ার আগেই তাঁর কয়েকটি প্রকাশনার সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল। এই প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে তথ্যবহুল গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বই দুটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এর লেখক ইতিহাসের যথার্থ প্রতিফলন নিশ্চিত করতে ব্যাপক পরিশ্রম করেছেন এবং তাঁর সব মেধা দিয়ে, গভীর আন্তরিকতার সাথে ইতিহাসের চিত্রটুকু সবার সামনে তুলে ধরতে নিবেদিত ছিলেন। এ কাজে কোনো খাদ তাঁর ছিল না।
আনোয়ার শাহজাহানের সাথে আমার পরিচয় হয় এই লন্ডনে বাংলা সংবাদকর্মীদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজকর্মের সুবাদে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আনোয়ার শাহজাহান স্বল্পভাষী কিন্তু অমায়িক একজন মানুষ, যিনি তাঁর সব কাজকে গ্রহণ করেন যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এবং সেই কাজটুকু সম্পন্ন করার জন্য তাঁর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়, তা তিনি পালন করেন নিষ্ঠার সাথে।

আনোয়ার শাহজাহানের অনেক পরিচিতি রয়েছে। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক, সংগঠক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও দানশীল। তবে তাঁর এসবই পরিচিতির ভিত্তি। আমার কাছে মনে হয়েছে, সঠিক তথ্যের অনুসন্ধানে তাঁর সনিষ্ঠ একাগ্রতা আর সবার থেকে আলাদা। এই অনুসন্ধানী মানস-জগৎ গড়ে ওঠে সমাজ-সংসার আর ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। এটি নিঃসন্দেহে এক বিরল গুণ। আনোয়ার শাহজাহান এই বিরল গুণের অধিকারী, এ জন্য তাঁর তারিফ করতেই হয়।
আমি জেনেছি, আনোয়ার শাহজাহানের মূল প্রেরণাদাত্রী তাঁর মহীয়সী মা। সেই ছোটবেলা থেকে যখনই কোথাও আনোয়ার শাহজাহানের কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর মা সেটি বারবার পড়েছেন, আরও ভালো লেখার জন্য তাঁকে প্রেরণা দিয়েছেন এবং কোথায় আরও ভালো করার সুযোগ রয়েছে, সেটি তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

লেখালেখিতে এভাবে একধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ আনোয়ার শাহজাহান পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। লেখক হিসেবে সন্তানের গড়ে ওঠার আকাক্সক্ষাকে তাঁর মা অসাধারণ মমতার সাথে এগিয়ে নিয়েছেন। বিষয়টি আনোয়ার শাহজাহানের জন্য কত বড় পাওয়া, তা নিশ্চয় তিনি এই পরিণত বয়সে অনুধাবন করতে পারেন।

আনোয়ার শাহজাহানের এগিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি তাঁর মা, এটি খুব আনন্দের সংবাদ। মায়ের আশীর্বাদ উৎসাহ আর প্রেরণা জোগায় এবং প্রতিভার বিকাশ নিশ্চিত করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে আমাদের যে সমাজ-সংসারের কাঠামো, সেখানে একজন মায়ের এই অপরিসীম অনুপ্রেরণার অনির্বচনীয় যে সংবাদ আমরা জানতে পারি, তা আমাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। এই লেখার সুবাদে আমি আনোয়ার শাহজাহানের আম্মার প্রতি জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আনোয়ার শাহজাহানের অন্যতম আগ্রহের একটি বিষয়। এটিও গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ করার মতো। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সিলেটের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ। এ বইগুলোর প্রতিটি ছত্রে বিধৃত হয়েছে বাঙালির মহত্তম অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অমর রচয়িতা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আনোয়ার শাহজাহানের গভীর মমতা, অসীম ভালোবাসা আর অকুণ্ঠ দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। সব তথ্য সর্বতোভাবে যাচাই-বাছাই শেষে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য আনোয়ার শাহজাহানের সনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ছবি আমরা তাঁর গ্রন্থগুলোয় দেখতে পাই।

আরও পড়ুন:  ফ্রিল্যান্সার থেকে তরুণ উদ্যোক্তা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের এই সময়ে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন ইতিহাসকে জনমানুষের মধ্যে সমভাবে পৌঁছে দিতে পারিনি। এ কারণে একাত্তরে ক্ষুদ্র একটি অংশ যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল, তেমনি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সেই অংশটি এবং তাদের অনুসারী গোষ্ঠী একই রকম বিরোধিতায় সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে নানা রকম বিরূপতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করেই চলেছে।

এদিকটি বিবেচনায় নিলে আনোয়ার শাহজাহান খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব পালন করেছেন বলতেই হয়। তিনি তাঁর জন্মমাটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরত্ব আর অশ্রু-বেদনার আখ্যান ইতিহাসবিদের মতো করে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। গোলাপগঞ্জের সেই ইতিহাস বিকৃত অথবা অস্বীকার করার সাহস কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর কখনোই হবে না। কারণ, গোলাপগঞ্জের মাটিতে জন্ম নেয়া এক সন্তান আনোয়ার শাহজাহান সেই মাটিতে প্রবাহিত শোণিত আর অশ্রুধারায় রচিত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব আর বিজয়ের কাহিনি লিখে নিয়েছেন।

আনোয়ার শাহজাহানের একই রকম নিষ্ঠা আমরা লক্ষ করেছি গোলাপগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গ্রন্থ রচনার বিষয়েও। ছোটবেলাতেই একসময় জন্মমাটির ইতিহাস জানার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি। বিভিন্ন গ্রন্থাগারে তিনি গোলাপগঞ্জের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য ঢুঁ দিতে থাকেন, কিন্তু তৃপ্তি পাওয়ার মতো তেমন কোনো গ্রন্থ তাঁর নজরে আসেনি। একসময় নিজেই সিদ্ধান্ত নেন গোলাপগঞ্জের ইতিহাস সংকলনের। মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা কতখানি সুগভীর হলে একজন মানুষ নিজেকে এভাবে সেই কাজে উৎসর্গ করতে পারে, এটি ভাবনায় নেয়ার মতো একটি বিষয়।

গোলাপগঞ্জ সিলেট অঞ্চলের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা। এ মাটিতে অনেক বরেণ্য মানুষের জন্ম। শিক্ষায় প্রাগ্রসর গোলাপগঞ্জ উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত মানুষ। তাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং তাদেরও একইভাবে অনুপ্রাণিত করার কাজে আনোয়ার শাহজাহানের গ্রন্থটি সামাজিক একটি আন্দোলনের মতো প্রভাব রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।

ধানখেতে কাদামাটি গায়ে মেখে নানা খেলায় মেতে ওঠা, শীতের বিকেলে খেতে খড়ে আগুন জ¦ালিয়ে আনন্দের ঝরনাধারায় অবগাহন করা, লোকজ মাটিতে অমর একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া আনোয়ার শাহজাহান আজ দুনিয়াজোড়া আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডন মহানগরের ব্যস্ত বাসিন্দা। কিন্তু সেই ধানখেত, সেই খড়ের আগুনে আলোর ঝিলিমিলি, সেই প্রভাতফেরির অপার্থিব আনন্দ তাঁর হৃদয় থেকে হারিয়ে যায়নি।

মায়ের হাত ধরে লেখালেখিতে তাঁর অভিষেক আর এগিয়ে যাওয়া, তারপর সাংবাদিকতায় বিচরণ, আরও লেখালেখি; সবকিছুতে আনোয়ার শাহজাহানের ভালোবাসা মানুষের জন্য। তাই গোলাপগঞ্জের ইতিহাস বলি আর বলি সেই মাটিতে বাঙালির গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকালীন কথা, আনোয়ার শাহজাহান বারবার সেখানেই ফিরে তাকান। কেননা তিনি জানেন, তাঁর শেকড় দৃঢ়ভাবে সেখানেই প্রোথিত, আর তিনি এ-ও জানেন, শেকড়বিহীন মানুষের মতো দুঃখী আর কেউ হয় না। খুব খুশির খবর, আনোয়ার শাহজাহান শেকড়বিহীন নন, শক্ত শেকড় থেকে উত্থিত মানুষটি জন্মমাটির প্রতি অপরিসীম মমতা নিয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।

লেখক পরিচিতি : এডিটর, ম্যাক্স মিডিয়া লন্ডন। সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top