বাঁশের ভিতরে ভরা বিন্নি ধানের চাল,বরাকের অতুলনীয় স্বাদের এই পিঠা — আশিস রঞ্জন নাথ

বিলেতের আয়না ডেক্স :- বাঁশের ভিতরে ভরা বিন্নি ধানের চাল,বরাকের অতুলনীয় স্বাদের এই পিঠা — আশিস রঞ্জন নাথ

পিঠা নিয়ে ছড়া লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তুলে ধরেছিলেন সিলেট তথা বরাক উপত্যকার মানুষের অতি প্রিয় চুঙা পিঠার কথা। লেখাটি ছিল এমন—
চুঙা পিঠা,আহা চাচা বলবো তোমায় কি
যখন ভাবি, ইচ্ছা হয় যে রেজিগনেশন দি।
ধরে সোজা পয়লা গাড়ী দেওর-আইলে দি ছুট
চাকরী বাঁধন রাজার শাসন সব কিছু ঝুটমুট।
শুধু মুজতবা আলীই নন, বিচিত্র এই চুঙা পিঠার অতুলনীয় স্বাদে বহুকাল ধরে মজে আছেন অসমের বরাক উপত্যকার মানুষজন। এই পিঠা শুধু তাঁদের প্রিয় খাবারই নয়, নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। ব্রিটিশ জমানায় সাহেবরাও বাঙালির সংস্পর্শে চুঙা পিঠায় মজেছিল। চুঙা পিঠার স্বাদ গন্ধ মুগ্ধ করেছিল তাদের। ব্রিটিশরা এই পিঠার নাম দিয়েছিল ‘Bamboo Cake’। বরাক উপত্যকার ডিমাসা,মণিপুরি, কার্বি, কুকি, মার,নাগা, খাসি টিপরা, রিয়াং-সহ অন্যান্য উপজাতিদেরও প্রিয় খাবার এই পিঠা। আবার ভিয়েতনাম থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত বাঁশের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বাঙালির মতোই সে সব দেশের মানুষেরও প্রধান খাদ্য ভাত। সে সুবাদে চুঙা পিঠারও প্রচলন রয়েছে।


কোনও পিঠার সঙ্গে Bamboo কিংবা চুঙা শব্দটা যখন জুড়ে যায়, তাতেই স্পষ্ট, এটিকে বাঁশের ভিতরেই তৈরি করতে হয়। বাঙালির পিঠেপুলির বিচিত্র ভাণ্ডারে অন্যদের থেকে যা একেবারেই স্বতন্ত্র। প্রথমে সরু ডলু জাতীয় বাঁশের (Bamboo) এক দিক বন্ধ থাকা পর্ব (স্থানীয় ভাষা ‘পাব’ বলা হয়) কেটে টুকরো করা হয়। তার ভিতরে বিশেষ কৌশলে কলাপাতা বা কুশিয়ারের পাতা ঢুকানো হয়। যাতে পাতা চুঙার ভিতরের দেয়ালে আস্তরণের সৃষ্টি করে। এরপর বিরুণ বা বিন্নি চাল ধুয়ে চুঙায় ভরে দেওয়া হয়। তাতে জল দিয়ে ভর্তি করা হয় যাতে পোড়ানোর সময় চুঙার ভিতরের চাল সেদ্ধ হতে সুবিধা হয়। পোড়ানোর আগে চুঙার মুখ মাপ মতো খড়ের ছোট আঁটি দিয়ে ঠেসে বন্ধ করে দেওয়া হয়। চুঙা পিঠা তৈরি করা বেশ জটিল। চাল ও জল মাপ মতো না হলে ঠিক ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয় না। এই পিঠা পোড়ার দৃশ্যও বেশ উপভোগ্য।
বিন্নি বা বিরুণ চালের পিঠে বা চুঙা পিঠা বেশ আঠালো হয়৷ আর এটাই এই চালের বিশেষত্ব। ভাতের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তার স্বাদ। কোনও কোনও বিন্নি চালে সুগন্ধ থাকে। এই চালের ধানকে স্থানীয় ভাষায় ‘গন্ধি বিরুণ’ বলা হয়। চুঙা পিঠার প্রধান উপকরণ বিন্নি বা বিরুণ ধান। এই ধানকে স্থানীয় ভাষায় ‘বিরইন ধান’ বলা হয়।এই ধানেরও হরেক জাত রয়েছে। যেমন পানি বিরইন,হাবি বিরইন,উবা বিরইন,গন্ধি বিরইন,আউশ বিরইন,পঙ্কজ বিরইন,আসরা বিরইন,পুটি বিরইন,খাগড়া বিরইন,লাকি বিরইন,খইয়া বিরইন,কারতিকা বিরইন ইত্যাদি। এই সব ধানের অধিকাংশই মূলত স্থানীয় জাতের। বাহারুল ইসলাম চৌধুরী নামে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (শিলচর) এক গবেষক বরাক উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্তত ২২ রকমের বিন্নি ধানের নাম ও নমুনা সংগ্রহ করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। সবই ছিল স্থানীয় জাতের। এর মধ্যে পঙ্কজ বিরইন সম্ভবত কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উদ্ভাবিত অধিক ফলনশীল জাত। তবে পরেশ নামে উন্নত ও অধিক ফলনশীল বিরইন ধান উদ্ভাবন করেছেন করিমগঞ্জ আকবরপুর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কৃষি বিজ্ঞানীরা।
সময়ের তাগিদে উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে অধিক ফলনশীল ধানের রমরমা চলছে। ক্ষেতের মাঠের দিকে তাকালে দেখা যাবে কম উৎপাদনশীল জাতের ধান আর নেই। ফলে নানা জাতের স্থানীয় ধান প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠেছে৷ বাঙালির পিঠের জগতে যা বিরাট ভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। তবে কম পরিমাণের জমিতে হলেও বিন্নি বা বিরইন ধান আজও দেখা যাচ্ছে৷ তা কেবল পিঠেপুলি ও চুঙা পিঠার জন্যই। এই ধানের সঙ্গে কৃষকদের মধুর সম্পর্ক জড়িত৷ পল্লীগীতিতেও বিন্নি ধান তার নিজস্ব স্থান অম্লান করে আছে। যেমন—
‘আমার বাড়ি যাইও মাঝি
বইতে দিমু পিড়া,
খাইতে দিমু তোমায় আমি
বিন্নি ধানের চিড়া।’
এমন আন্তরিকতায় ভরপুর পল্লীগীতিতে মাঝি একান্ত আপনজন হয়ে ওঠেন। আদরযত্নে তাঁকে বিন্নি ধানের চিড়া (চিড়ে) দিয়ে আপ্যায়ন করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর এই বিন্নি ধান জড়িয়ে রয়েছে বরাকের চুঙা পিঠার অতুলনীয় স্বাদে। পিঠেপুলির জগতে আজকের দিনে অধিকাংশ বাঙালির দৌড় পাটিসাপটা কিংবা চিতই পিঠা পর্যন্ত। হারিয়ে যেতে বসেছে পুলি পিঠা,কুলি পিঠা, মেড়া পিঠা, ঘিলা পিঠা তেতইপিঠা,নৌকাপিঠা, লাঙ্গলপিঠা খুদপিঠা, তালের পিঠা, তিলের পিঠা,নারকেল পিঠা, আপানি পিঠা, হান্দেশপিঠা, বকুলপিঠা, বকপিঠার মতো পিঠেপুলির কত বিচিত্র স্বাদ। তবে আজও বরাক উপত্যকায় চুঙা পিঠার বিশেষ সমাদর রয়েছে। আর শীতের মরসুমের সঙ্গেই নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এই পিঠার।
ঠিক কবে থেকে বরাক উপত্যকার সব সম্প্রদায়ের মানুষ চুঙা পিঠায় মজেছেন, তা বলা কঠিন। তবে এ খাদ্য বাঙালি যে উপজাতিদের থেকে ধার নিয়েছে— সেটা সত্যি। বাঙালির ব্রত উপাচারেও চুঙা পিঠার ব্যবহার রয়েছে। বরাক উপত্যকার প্রচলিত ‘বাঘাই বর্ত্ত (পুরুষালি ব্রত), ‘ডাইনির হাওভাত’ (মেয়েলি ব্রত) এবং পৌষ মাসে মুসলিমদের এক বিশেষ শিরণিতে চুঙা পিঠা ব্যবহারের রীতি রয়েছে।

আরও পড়ুন:  ভোট কেন্দ্রে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কে স্বচক্ষে দেখেছি - সিইসি হাবিবুল আওয়াল।

Share:

Facebook
Twitter
Pinterest
LinkedIn
Scroll to Top