বিলেতের আয়না ডেক্স :- আরেকটা ৭ সমাগত
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
পশ্চিমা জগতে এই বিশ্বাস দৃঢ়, তের সংখ্যাটি হলো দুর্ভাগ্যের প্রতীক আর সাত সংখ্যাটি সৌভাগ্যের প্রতীক। কাকতালীয়ভাবে বাঙালি জীবনে সাত সংখ্যাটাই সৌভাগ্যের বাহন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রথমেই ১৯৫২ সাল দিয়ে শুরু করা যাক। এই সম্পর্কে সকলের কম বেশি জ্ঞান আছে। ’৫২-এর মাঝে (৫+২) = ০৭ সংখ্যাটি পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী বাঙালির মুক্তির অন্বেষার প্রথম সোপানটি বাঙালিরা ’৫২ সালেই অতিক্রম করে। এরপর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরের কথা। পাকিস্তানের সেদিনের সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সেনা শাসন জারির মাধ্যমে সারা দেশের ক্ষমতা গ্রহন করে। এই ৭ অক্টোবরকে অনেকে ‘সমাপ্তির শুরুটা’ বলে মন্তব্য করে।
বস্তুত, আইয়ুব খানের সেনা শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বাঙালির স্বাধিকার ও রাষ্ট্র-চিন্তা বিকশিত হতে থাকে। এই আইয়ুব খানের শাসনামলে তারই সুবেদার মোনেম খান পাকিস্তানিদের পদলেহীতার চূড়ান্ত রেকর্ড সৃষ্টি করে। এই সময় আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে মৌলিকতা দিয়ে তথাকথিত মৌখিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর থেকেই শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাথে থাকা অসম্ভব ও অবাস্তব।
১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের মধ্যকার শ্বাসরুদ্ধকর দুটো ঘটনা হলো ভারতের কাশ্মীর ও পশ্চিম রনাঙ্গনে সশস্ত্র সংঘাত। সেদিন পাকিস্তানের পূর্বাংশ সম্পূর্ণ অরক্ষিতই ছিল। কারও কারৗ ধারণা ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান কাশ্মীরের আরও কিছু অংশ কব্জা করতে পারলে তারা তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটা মীমাংসায় আসত। অপর ঘটনাটি হচ্ছে শেখ মুজিব কর্তৃক ৬ দফা প্রস্তাব পেশ। এই ৬ দফায় গণতন্ত্রের কথা ছিল, স্বায়ত্বশাসনের কথা ছিল; একই দেশে দুটো কারেন্সি বা দুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা ছিল, যার যার বৈদেশিক মুদ্রা তার তার নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবহারে বিধান রাখার কথা ছিল। আর ছিল যে কোনো একটি বাহিনীর প্রধান কার্যালয় পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরের সুষ্পষ্ট দাবি ও এক লাখের মতো একটি প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এই সব প্রস্তাবের শেষ কথাটা ছিল স্বাধীনতা; তা জানত বলে পাকিস্তানিরা ৬ দফাকে মূলে নির্মূলের পদক্ষেপ নিয়েছিল।
শেখ মুজিবের নিজের দলে বিভক্তি, প্রদেশও কেন্দ্রে শিখণ্ডিত দাঁড় করিয়ে কিংবা অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করে এই দাবিগুলোকে চোখের আড়ালে ঠেলে দেবার প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা ছিল। এমনকি ৬ দফাকে সি-আইএর পরিকল্পনা ও কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিপক্ষ বলেও প্রচারণা করা হলো। এত সবের পরও শেখ মুজিব ও তার দল দমে না যাওয়াতে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব ও মোনেম জেল-জুলুম ও নির্যাতনের পথ গ্রহণ করে। সুবেদার মোনেম খান ঘোষণা দেন তিনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবকে জেলের অভ্যন্তরে থাকতে হবে।
১৯৬৬ সালের প্রথম ভাগে লাহোরে ৬ দফা ঘোষিত হয়। শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এসে পার্টি কংগ্রেসে ৬ দফাকে ‘আমাদের বাঁচার দাবি বলে’ ঘোষণা দিয়ে তা পাস করিয়ে নেন। তারপর থেকেই শুরু হয় জেল-জুলুম, হাজতবাস, একের পর এক গ্রেপ্তারি, মুক্তি, আর গ্রেপ্তার, আবার হাজতবাস, আবার মুক্তি, আবার গ্রেপ্তার। দেশের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত এই হয়রানিও নির্যাতনের স্টিমরোলার চলতেই থাকে। এতসবের পরও শেখ মুজিব অটলই রইলেন।
যখন দেখা গেল সারা দেশ প্রায় জেগে উঠছে এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে তখন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার শেখ মুজিবকে স্থায়ী ভাবে ১৯৬৬ সালের মে মাসে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ৭ মে ছিল শেখ মুজিবের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের শেষ দিন আর সশস্ত্র যুদ্ধ প্রস্তুতির শুভ সূচনা। একই সাথে ব্যাপক হারে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের জেলে পুড়ে ফেলা হলো। এমন একটি মুহূর্তে শেষ ভরসা হিসেবে শেখ মুজিব গোপনে ও কৌশলে জেলে থেকেই ছাত্র ও যুবনেতাদের প্রতিবাদের নির্দেশ দিলেন। বিস্তারিত প্রস্তুতির পর ৭ জুন সারাদেশে হরতাল আহবান করা হলো।
ব্যাপক সংখ্যায় ছাত্ররা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেও যুব ও শ্রমিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। বস্তুত: শ্রমিক আন্দোলনকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ছিলেন আইয়ুবদের স্বপক্ষে আর ৬ দফার বিপক্ষে। কিন্তু ৭ জুনের কতিপয় ঘটনায় বিশেষত: চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া একজন শ্রমিককে প্রকাশ্যে গুলি করায় তেজগাঁয়ের শ্রমিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের বিদ্রোহের খবর না জেনেও সারা দেশে বহু জায়গায় ছাত্র-শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে প্রবল আঘাত হানে এবং সারাদেশ সম্পূর্ণ অকেজো করে দেয়। এদেশে এধরনের হরতাল আগে কেউ কখনও দেখেনি। এই দিন মনু মিয়া, আবুলসহ সারা দেশে কমপক্ষে ১১ জন শ্রমিক জনতা নিহত হয়। সেদিনই বহু জায়গায় বহু গ্রেপ্তার ও হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেদিনই বিক্ষুব্ধ- ছাত্র নেতারা বিকালে কার্জন হলে বসে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
কার্যত: আর একটি সাত সংখ্যাই বাঙালির স্বাধীনতায় উত্তরণে আরেকটি সোপান তৈরি করে। তারপর ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সংখ্যা-গরিষ্ঠতা অর্জন, ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত ঘোষণা ও আহবান ২৫ মার্চ রাতে (২+৫ = ০৭) স্বাধীনতার ঘোষনা এবং ১৬ (১+৬ = ০৭) ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জন। মনে হচ্ছে সবই ৭ এর খেলা। দুঃখের বিষয় ৭ জুন সম্পর্কে অবগতদের সংখ্যা হাতে গোনা কয়জন মাত্র।
সেদিন পিকেটিংয়ের সময় পুলিশ আমার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। আবদুর রাজ্জাক হাইকোর্টের সামনে আমাকে সজোরে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে না দিলে আমার মাথার খুলি উড়ে যেত। সেদিনই পড়ন্ত বেলায় নূরে আলম সিদ্দিককে মনু মিয়ার রক্ত মাখা সার্ট নিয়ে ফজলুল হক হলে উপস্থিত দেখেছিলাম। বিকালে অবশ্য ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী মতিয়া চৌধুরী কার্জন হলে এসে আমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। সেদিনই আমরা স্বাধীনতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বি এল এফ বা পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী)-কে পূর্ণগঠনের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া হয়। এরপর আমরা আর একবারও পিছু টান অনুভব করিনি।
ছয় দফার সবকটি দফাকে ১১ দফার একটি দফায় সন্নিবেশিত করে আমরা আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করি যার ফলে শেষ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আনীত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিত্যক্ত হয়, আইয়ুব মোনায়েমের পতন ঘটে। ইয়াহিয়া খান পুরোনো রঙ্গমঞ্চে নবরূপে আবির্ভূত হন। ছাত্র, যুবা ও রাজনৈতিক দল বিশেষত: আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড ও প্রখর আন্দোলনে ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতাসহ যে কোনো প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জনের ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর লক্ষামুখী ও কৌশলী পদক্ষেপে ২৬ মার্চ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করি।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমরা উন্মুখ হয়ে আছি ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি কী হবে, তা দেখতে। আমরা তো ৭ তারিখকে শুভ দিন ধরেই জেনে আসছি। আমাদের আজও কামনা এটাই। আমাদের শুভবুদ্ধির কারণেই দিনটির আদি চরিত্র ধরে রাখা সক্ষম হবে বিশ্বাস করছি।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী।