বিলেতের আয়না ডেক্স :- বরিশালের জনসভায় প্রধান মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি একটি সন্রাসী দল, রাজনীতির করার কোন অধিকার নেই।
বরিশাল বিভাগ ছিল অন্ধকার। আওয়ামী লীগ সরকার এসেছে. আজকে এখানে আলো জ্বলছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে আজ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। বরিশালবাসীর জন্য সুখবর আছে। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ছয় লেনের আধুনিক সড়ক করে দেব। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে আমরা অর্থ নেব। এই বরিশালে আর কোনো কষ্ট থাকবে না।
শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) বিকেলে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম ডিসেম্বরে। আজকে উপস্থিত হয়েছি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন, সেই নির্বাচন সামনে রেখেই আজকে আপনাদের কাছে এসেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিত্য সঙ্গী ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ করবেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন। মাত্র তিন বছর সাত মাস তিন দিন হাতে সময় পেয়েছিলেন। রিজার্ভে টাকা ছিল না। গোলায় এক ফোটা খাবার ছিল না। যুদ্ধকালীন সময়ে মাঠে কোনো ফসল ফলেনি। রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ সবই বিধ্বস্ত। দুটি পোর্টে মাইন পোতা। শূন্য হাতে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯৭২ সালে যখন তিনি দায়িত্ব নেন তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৯১ ডলার। দুঃখ-দারিদ্র্য জাতির পিতাকে পীড়া দিতো, কষ্ট দিতো। তাই নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি সরকারে আসার পর নয় মাসের মধ্যে আমাদের একটি সংবিধান দেন। যে সংবিধানে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সুযোগ দেবে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয় ২৭৭ ডলারে উন্নীত করেন। শুধু তাই নয়, দুটি পোর্ট মাইনমুক্ত করা, রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ, রেল সব উন্নত করা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। দেশের মানুষ যারা একেবারে হতদরিদ্র তাদেরকে খাসজমি বিতরণ, বিনা পয়সায় ঘর দেওয়া। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়াসহ বিনা পয়সায় বই, বিনামূল্যে কাপড়-চোপড় পর্যন্ত তিনি দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর শুধু যে একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে তা নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা হয়েছিল। স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছিল। শুধু তাই নয়, জয় বাংলার স্লোগান নিষিদ্ধ, ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ, জাতির পিতার ছবিও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। জাতির পিতা মাথাপিছু আয় যেখানে রেখে গিয়েছিলেন, এরপর অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে হত্যা, গুম ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে জিয়া ক্ষমতায় আসে। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ওই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়নি। দারিদ্র্যের হার কমাতে পারেনি। শিক্ষার হার বাড়াতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই ছিল।
তিনি বলেন, একমাত্র যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে, আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। বাংলাদেশেকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩০০ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি করেছিলাম। খাদ্য উৎপাদন ৭৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করেছিলাম। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। সাক্ষরতার হার ৪৫ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ দশমিক ৫ ভাগে বৃদ্ধি করেছিলাম। বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। দুর্ভাগ্য ২০০১ সালে সরকারে আসতে পারিনি। কেন পারিনি? আমাদের সম্পদ বিক্রি হবে, সম্পদের মালিক জনগণ অথচ বিক্রি করতে হবে। আমি চাইনি। আমি নাকচ করে দিয়েছিলাম। খালেদা জিয়া মুচলেকা দিয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় আসলে বিক্রি করবে। চক্রান্ত করে ২০০১ সালে আমাদের হারানো হয়। এরপর আওয়ামী লীগের ওপর যে অত্যাচার চলেছিল, এই বরিশালবাসী-পুরো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, এখানে সাংবাদিক আসতে পারতো না। অকাতরে অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। বরিশাল থেকে ২৫ হাজার জনগণ কোটালীপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হাত কাটা, পা কাটা, চোখ তোলা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিঠের হাড় গুঁড়ো করে মারা, বাড়িঘর দখল, মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। কত মানুষ ভয়ে আত্মহত্যা করেছে। এভাবে বিএনপির অত্যাচার চলেছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে অন্ধকার যুগ। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন না হলেও বিএনপি-জামায়াতের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। সমস্ত দেশে গ্রেনেড হামলা, বোমা হামলা, এমনকি আমার ওপরেও গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। এই বাংলাদেশে তারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দুর্নীতির অভয়ারন্য করেছিল। তাদের দুঃশাসন, দুর্নীতি যার কারণে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ২০০৭ থেকে ২০০৮ আমাদের গ্রেপ্তার করা হয়। নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। তারপরও জনগণের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ এর নির্বাচনের ফলাফল দেখুন। এককভাবে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৩টি আসন পায়। বিএনপি তার ২০ দলীয় জোট নিয়ে মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। তাদের দুঃশাসন জনগণ প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল তাই ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ১৫ বছর আমরা ক্ষমতায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। সার্বিকভাবে প্রতিটি জেলা, উপজেলায় ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা যতদূর পেরেছি আমরা নির্মাণ করে দিয়েছি। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি। যেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ছিল আজকে সেখানে ৪ কোটি ৯২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হয়। যে মানুষটা এক বেলা খেতে পারতো না আজকে তারা তিন বেলা খেতে পারে। দুর্ভিক্ষ নেই, মঙ্গা নেই, কাজের জন্য হাহাকার নেই। আমরা শিক্ষার দিকেও নজর দিয়েছি। বিনা পয়সায় বই দিচ্ছি। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা পর্যন্ত আমরা তিন কোটি ৯৪ লাখ ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে উপবৃদ্ধি দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। যে বই বাবা-মায়ের কিনতে হতো সেই দায়িত্ব আওয়ামী লীগ সরকার নিয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছি। ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনা পয়সায় আমরা দিয়ে থাকি। সামাজিক নিরাপত্তা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছি। দুস্থ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাস তৈরি করে দিচ্ছি। এর ফলে কমপক্ষে ১০ কোটি মানুষ আজ উপকারভোগী।
আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, বরিশাল এক সময় ছিল শস্য ভান্ডার। আবার আমরা সেই ভান্ডারের সুনাম ফেরাতে সাইলো নির্মাণ করছি। আমরা বরিশালে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করে দেব। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছি, মেরিন একাডেমি করে দিয়েছি। তাছাড়া প্রতিটি নদীর ওপর সেতু করে দিচ্ছি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, সারা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি।
স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বরিশালে আসতাম ছোটবেলায়। সন্ধ্যায় স্টিমারে উঠতাম। দুপুরে এসে নামতাম। তখন ঘোড়ার গাড়ি চলতো। ঘোড়ার গাড়িতে উঠে আমরা ফুফুর বাড়িতে যেতাম। বলতে হতো কালীবাড়ী রোড সুধীর বাবুর বৈঠকখানার সামনে যেতে হবে। কিন্তু আজকে সেই অবহেলিত বরিশালের উন্নতি হয়েছে।
তিনি বলেন, বরিশাল বিভাগে নৌবাহিনীর ঘাঁটি করেছি, সেনানিবাস তৈরি করেছি। এই এলাকার উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি। ভোলার গ্যাস এখন ঢাকায় নিচ্ছি। ভবিষ্যতে বরিশালেও নিয়ে আসবো শিল্প কারখানা যাতে গড়ে ওঠে। আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল কুয়াকাটায় চলে আসবে। ৬ লাখ ৮০ হাজারের ওপরে ফ্রিল্যান্সার আজ ঘরে বসে বিদেশে কাজ করে আয় করেন। আমরা ১০৯টি হাইটেক পার্ক তৈরী করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যখন জনগণের জন্য উন্নয়ন করি, তখন ওই বিএনপি-জামায়াত করে অগ্নিসন্ত্রাস। রেললাইনের ফিস প্লেট ফেলে দিয়ে, বগি ফেলে দিয়ে মানুষ হত্যার ফাঁদ পাতে। রেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। মা-সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে- এই অবস্থায় আগুনে পুড়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই দৃশ্য পুরো বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন, ঠিক ২০০১ সালে শুরু করেছিল। এরপর ১৩-১৪ একই ঘটনা ঘটায়। এখন আবার অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে। আমি ধিক্কার জানাই বিএনপি-জামায়াতকে।
তিনি বলেন, বিএনপি হচ্ছে একটা সন্ত্রাসী দল। এই সন্ত্রাসী দলের রাজনীতি করার অধিকার বাংলাদেশে নেই। কারণ তারা মানুষ পোড়ায়, মানুষ হত্যা করে। আমাদের রাজনীতি মানুষের কল্যাণে, আর ওদের রাজনীতি মানুষ হত্যায়। তাদের মানুষ চায় না।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের আপামর মানুষের মার্কা হচ্ছে নৌকা। এই নৌকা হচ্ছে নূহ নবীর নৌকা। যে নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা করেছিল। এই নৌকায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। এই নৌকায় ভোট দিলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব। ওই অগ্নিসন্ত্রাসীরা পারে না।
তিনি জসনসভায় উপস্থিত নেতাকর্মীদের হাত তুলে নৌকায় ভোট দেওয়ার ওয়াদা করান।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, বরিশালের সন্তান অভিনেতা মীর সাব্বির, অভিনেত্রী তারিন জাহান প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস জনসভা সঞ্চালনা করেন।