বিলেতের আয়না ডেক্স :- আজ ১০ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারী। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারী এইদিনে তিনি পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। বাঙালি জাতির জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় দিন।
এর আগে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন তিনি। পরে তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যান। তারপর দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন মুক্তির মহানায়ক। সেদিন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রাণবন্ত অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। স্বয়ং জাতির জনক তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’। সেই থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়।
জীবনমৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারাজীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলার বিজয়। তাই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের। আজকের এ দিনে তিনি জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক কালজয়ী মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পায়। আমাদের মহান নেতার আগমনে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ পরিপূর্ণতা লাভ করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করে। লাখ লাখ নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা চালায় তারা। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পরপরই তিনি বাংলাদেশে ছুটে আসতে চান। ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো তাকে তেহরান বা অন্য কোনো এয়ারলাইন্স বেছে নিতে বললে তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে আসার সিদ্ধান্ত নেন। লন্ডন পৌঁছে তিনি বিবিসিতে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। তিনি যখন ভরাট কণ্ঠে তার সুস্থতার কথা জানান, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে লাখ লাখ বাঙালি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। তখনও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্রিটিশ বিরোধী দলীয় নেতা হ্যারাল্ড উইলসনও তাকে স্বাগত জানাতে সাক্ষাৎ করেন। তাকে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা।
লন্ডন থেকে দিল্লিতে পৌঁছান অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র দেশবাসী তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেন। এ সময় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকার জন্য ভারতবাসী ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এরপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তিনি পা রাখেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত লাখ লাখ বাঙালি সেই মুহূর্তে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফিরে পেয়ে। পুরো দেশই তাকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিল, তার কিছুটা চিত্র ধরা পড়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে। জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠা বিমানবন্দর যেন বাংলার আকাশ-বাতাসকেই প্রতিনিধিত্ব করছিল। পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ সেই মুহূর্তে অবিস্মরণীয় এই নেতাকে গ্রহণ করতে অংশ নিয়েছিলেন। মহান এই নেতাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ব্যাকুলতা কাজ করছিল। তাকে বহনকারী ট্রাকটিও সে সময় ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যার সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনতার উদ্দেশে দেয়া প্রথম সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে সবাইকে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাব।’ রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন বছর সাত মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কুচক্রি মহলের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন তিনি। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শোধ করে যান সেই ঋণ।