বিলেতের আয়না ডেক্স :- আজ শহীদ শাহজাহান সিরাজের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী।
‘ঘুমাও শান্তিতে শাজাহান সিরাজ’
এবিএম জাকিরুল হক টিটন
আজ ২২শে ডিসেম্বর। মতিহারের মহাপ্রাণ শহীদ শাহজাহান সিরাজের ৩৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৪ সাসের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দেয়।
ধর্মঘট সর্মথন করে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ১৫ দল, ৭ দল, ১৭টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন ও সম্মিলিত আইনজীবী পরিষদ।
সেই ধর্মঘট আন্দোলন হরতালে রূপ নেয়। ধর্মঘট সফল করতে সেসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন, কাজলা গেট এলাকায় অবস্থান নেন। তবে ক্যাম্পাসের সকল সংগঠনের মূল নেতা ভোরের আলো ফোটার আগেই অবস্থান নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। তারপর শুরু হয় কুয়াশাভেজা মিছিল।
তার কিছুক্ষণ পর রাজশাহী শহরের দিক থেকে বিডিআর ভর্তি ট্রেন আসে বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে। বিডিআর’রা এসেই আমাদের আগের রাতের দেওয়া ব্যারিকেডগুলো লাইন থেকে সরে নিতে বলে। তখন মিছিলের সামনে থেকে তাদের সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাবি জাসদ ছাত্রলীগ সম্মেলন প্রস্ততি কমিটির আহ্বায়ক শাহজাহান সিরাজ।
বিডিআর’রা উনার সাথে কথা বলার উদ্যোগ না নিয়ে বলতে থাকে লাল সার্ট ওলাকে ফায়ার ফায়ার।
সঙ্গে সঙ্গে বিডিআর শাহজাহান ভাইয়ের লাল সার্টকে টার্গেট করে গুলি ছোড়ে। শাহজাহান ভাইয়ের বুকে বুলেট বিদ্ধ হয়ে রাবি স্টেশনে লুটে পড়েন। পরের গুলি সোহরাওয়ার্দী হলের তিন তালার বারান্দায় বিদ্ধ হয় পত্রিকার হকার আব্দুল আজিজের মাথায়। হকার আজিজ ওখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ছাত্রদের রক্তের সাথে শ্রমিকদের রক্ত একই ধারায় প্রবাহিত হয়।আর তাই ২২ ডিসেম্বরকে ঘোষণা করা হয় ‘ছাত্র-শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসাবে। সেইদিন একই সময়ে স্টেশন ও হলের মাঝামাঝি স্থানে গুলি বিদ্ধ হয়ে আহত হন ছাত্রনেতা রহুল কবির রিজভী। আমরা হারাই আমাদের প্রাণের নেতা শহীদ শাহজাহান সিরাজকে।
আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দিন থেকে শাহজাহান ভাইয়ের সাথে প্রায় সব সময় থাকতাম। উনি আমাকে বলতো এই ভাঙা ছাত্রলীগকে চাঙ্গা করতে হবে। তুমি বগুড়ার সবাইকে দলে আনবে। বিশেষ করে ওনার মৃত্যুর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনকে সামনে রেখে সারাক্ষণ উনার সাথে থাকতাম। উনি ছিলেন সম্মেলন প্রস্ততি পরিষদের আহ্বায়ক আর আমি ছিলাম উনার সেই কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের আহ্বায়ক। শাহজাহান ভাই চাইতেন সম্মেলনটা যেন বিশাল উৎসবে পরিণত হয়। উনি শহীদ হওয়ার পর আমরা উনার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলাম। যদিও উনি সেটা দেখে যেতে পারেননি। শাহজাহান ভাই শহীদ হওয়ার পরে ক্যাম্পাস খোলার পর থেকে এই মহান শহীদকে নিয়ে আমরা আবেগে ভাসতে থাকি। তখন মূলত ক্যাম্পাসে আমি স্লোগান মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিলাম। শাজাহান ভাইয়ের কথা মনে হলেই উনাকে নিয়ে রচনা করতাম অসংখ্য স্লোগান।
যেমন :
“মতিহারের মহা প্রাণ,
শাজাহান- শাজাহান। ”
“আন্দোলনের মহাপ্রাণ,
শাজাহান-শাজাহান। ”
“রজব আলীর জানের জান,
শাজাহান-শাজাহান। ”
“তোমার আমার প্রাণের প্রাণ,
শাজাহান -শাজাহান। ”
“দ্বীপ শিখা অনির্বাণ,
“শাজাহান-শাজাহান। ”
“গোশায় পুরের মহাপ্রাণ,
শাজাহান-শাজাহান। ”
“মরেও তুমি অমর আজ,
বিপ্লবী শাজাহান সিরাজ। ” আরো কত কী। কত লিখি। অনেক কিছু ৩৭ বছরে ভুলেও গিয়েছি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত শাজাহান ভাইকে ভুলতে পারিনি। প্রতি বছর ২২ ডিসেম্বর সারাদিন মন খারাপ করে ভাবি, যে কারণে শহীদ শাজাহান সিরাজসহ শত শহীদ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই গণতন্ত্র কী এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে ?
পরিশেষে কবি মোহন রায়হানের ছন্দে বলতে হয়, ‘শোক নয় প্রতিশোধ নেবো আজ, ঘুমাও শান্তিতে শাজাহান সিরাজ। ’
লেখক : সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ